গোরা

পানুবাবু ইস্কুলে মাস্টারি করেন। বরদাসুন্দরী তাঁহাকে ইস্কুল-মাস্টার মাত্র জানিয়া বড়ো শ্রদ্ধা করেন না। তিনি ভাবে দেখান যে, পানুবাবু যে তাঁহার কোনো মেয়ের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করিতে সাহস করেন নাই সে ভালোই হইয়াছে। তাঁহার ভাবী জামাতারা ডেপুটিগিরির লক্ষ্যবেধরূপে অতি দুঃসাধ্য পণে আবদ্ধ।

সুচরিতা হারানকে এক পেয়ালা চা অগ্রসর করিয়া দিতেই লাবণ্য দূর হইতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া একটু মুখ টিপিয়া হাসিল। সেই হাসিটুকু বিনয়ের অগোচর রহিল না। অতি অল্প কালের মধ্যেই দুই-একটা বিষয়ে বিনয়ের নজর বেশ একটু তীক্ষ্ণ এবং সতর্ক হইয়া উঠিয়াছে–দর্শননৈপুণ্য সম্বন্ধে পূর্বে সে প্রসিদ্ধ ছিল না।

এই যে হারান ও সুধীর এ-বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে অনেক দিন হইতে পরিচিত, এবং এই পারিবারিক ইতিহাসের সঙ্গে এমন ভাবে জড়িত যে তাহারা মেয়েদের মধ্যে পরস্পর ইঙ্গিতের বিষয় হইয়া পড়িয়াছে, বিনয়ের বুকের মধ্যে ইহা বিধাতার অবিচার বলিয়া বাজিতে লাগিল।

এ দিকে হারানের অভ্যাগমে সুচরিতার মন যেন একটু আশান্বিত হইয়া উঠিল। গোরার স্পর্ধা যেমন করিয়া হউক কেহ দমন করিয়া দিলে তবে তাহার গায়ের জ্বালা মেটে। অন্য সময়ে হারানের তার্কিকতায় সে অনেক বার বিরক্ত হইয়াছে, কিন্তু আজ এই তর্কবীরকে দেখিয়া সে আনন্দের সঙ্গে তাঁহাকে চা ও পাঁউরুটির রসদ জোগাইয়া দিল।

পরেশ কহিল, “পানুবাবু, ইনি আমাদের–”

হারান কহিলেন, “ওঁকে বিলক্ষণ জানি। উনি এক সময়ে আমাদের ব্রাহ্মসমাজের একজন খুব উৎসাহী সভ্য ছিলেন।”

এই বলিয়া গোরার সঙ্গে কোনোপ্রকার আলাপের চেষ্টা না করিয়া হারান চায়ের পেয়ালার প্রতি মন দিলেন।

সেই সময়ে দুই-এক জন মাত্র বাঙালি সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হইয়া এ দেশে আসিয়াছেন। সুধীর তাঁহাদেরই একজনের অভ্যর্থনার গল্প তুলিল। হারান কহিলেন, “পরীক্ষায় বাঙালি যতই পাস করুন, বাঙালির দ্বারা কোনো কাজ হবে না।

কোনো বাঙালি ম্যাজিস্‌্‌ট্রেট বা জজ ডিস্ট্রিক্টের ভার লইয়া যে কখনো কাজ চালাইতে পারিবে না ইহাই প্রতিপন্ন করিবার জন্য হারান বাঙালির চরিত্রের নানা দোষ ও দুর্বলতার ব্যাখ্যা করিতে লাগিলেন।

দেখিতে দেখিতে গোরার মুখ লাল হইয়া উঠিল–সে তাহার সিংহনাদকে যথাসাধ্য রুদ্ধ করিয়া কহিল, “এই যদি সত্যই আপনার মত হয় তবে আপনি আরামে এই টেবিলে বসে বসে পাঁউরুটি চিবোচ্ছেন কোন্‌ লজ্জায়!”

হারান বিস্মিত হইয়া ভুরু তুলিয়া কহিলেন, “কী করতে বলেন?”

গোরা। হয় বাঙালি-চরিত্রের কলঙ্ক মোচন করুন, নয় গলায় দড়ি দিয়ে মরুন গে। আমাদের জাতের দ্বারা কখনো কিছুই হবে না, এ কথা কি এতই সহজে বলবার? আপনার গলায় রুটি বেধে গেল না?

হারান। সত্য কথা বলব না?

গোরা। রাগ করবেন না, কিন্তু এ কথা যদি আপনি যথার্থই সত্য বলে জানতেন তা হলে অমন আরামে অত আস্ফালন করে বলতে পারতেন না। কথাটি মিথ্যে জানেন বলেই আপনার মুখ দিয়ে বেরোল। হারানবাবু, মিথ্যা পাপ, মিথ্যা নিন্দা আরো পাপ, এবং স্বজাতির মিথ্যা নিন্দার মতো পাপ অল্পই আছে।

হারান ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। গোরা কহিল, “আপনি একলাই কি আপনার সমস্ত স্বজাতির চেয়ে বড়ো? রাগ আপনি করবেন–আর আমাদের পিতৃপিতামহের হয়ে আমরা সমস্ত সহ্য করব!”

ইহার পর হারানের পক্ষে হার মানা আরো শক্ত হইয়া উঠিল। তিনি আরো সুর চড়াইয়া বাঙালির নিন্দায় প্রবৃত্ত হইলেন। বাঙালি-সমাজের নানাপ্রকার প্রথার উল্লেখে কহিলেন, “এ-সমস্ত থাকতে বাঙালির কোনো আশা নেই।”

গোরা কহিল, “আপনি যাকে কুপ্রথা বলছেন সে কেবল ইংরেজি বই মুখস্থ করে বলছেন, নিজে ও সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। ইংরেজের সমস্ত কুপ্রথাকেও যখন আপনি ঠিক করেই এমনি অবজ্ঞা করতে পারবেন তখন এ সম্বন্ধে কথা কবেন।”

পরেশ এই প্রসঙ্গ বন্ধ করিয়া দিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু ক্রুদ্ধ হারান নিবৃত্ত হইলেন না। সূর্য অস্ত গেল; মেঘের ভিতর হইতে একটা অপরূপ আরক্ত আভায় সমস্ত আকাশ লাবণ্যময় হইয়া উঠিল; সমস্ত তর্কের কোলাহল ছাপাইয়া বিনয়ের প্রাণের ভিতরে একটা সুর বাজিতে লাগিল। পরেশ তাঁহার সায়ংকালীন উপাসনায় মন দিবার জন্য ছাত হইতে উঠিয়া বাগানের প্রান্তে একটা বড়ো চাঁপাগাছের তলায় বাঁধানো বেদিতে গিয়া বসিলেন।

গোরার প্রতি বরদাসুন্দীর মন যেমন বিমুখ হইয়াছিল হারানও তেমনি তাঁহার প্রিয় ছিল না। এই উভয়ের তর্ক যখন তাঁহার একেবারে অসহ্য হইয়া উঠিল তিনি বিনয়কে ডাকিয়া কহিলেন, “আসুন বিনয়বাবু, আমরা ঘরে যাই।”

বরদাসুন্দরীর এই সস্নেহ পক্ষপাত স্বীকার করিয়া বিনয়কে ছাত ছাড়িয়া অগত্যা ঘরের মধ্যে যাইতে হইল। বরদা তাঁহার মেয়েদের ডাকিয়া লইলেন। সতীশ তর্কের গতিক দেখিয়া পূর্বেই চিনাবাদামের কিঞ্চিৎ অংশ সংগ্রহ-পূর্বক খুদে কুকুরকে সঙ্গে লইয়া অন্তর্ধান করিয়াছিল।

বরদাসুন্দরী বিনয়ের কাছে তাঁহার মেয়েদের গুণপনার পরিচয় দিতে লাগিলেন। লাবণ্যকে বলিলেন, “তোমার সেই খাতাটা এনে বিনয়বাবুকে দেখাও-না।”

বাড়ির নূতন-আলাপীদের এই খাতা দেখানো লাবণ্যর অভ্যাস হইয়াছিল। এমন-কি, সে ইহার জন্য মনে মনে অপেক্ষা করিয়া থাকিত। আজ তর্ক উঠিয়া পড়াতে সে ক্ষুণ্ন হইয়া পড়িয়াছিল।

0 Shares