গোরা

তাহার পরে হারান যখন গোরা ও বিনয়ের অসাক্ষাতে ক্ষুদ্র-ঈর্ষা-বশত তাহাদের প্রতি অভদ্রতার অপবাদ আরোপ করিলেন তখনো এই অন্যায় ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে সুচরিতাকে গোরাদের পক্ষে দাঁড়াইতে হইল।

অথচ গোরার বিরুদ্ধে সুচরিতার মনের বিদ্রোহ একেবারেই যে শান্ত হইয়াছে তাহাও নহে। গোরার একপ্রকার গায়ে-পড়া উদ্ধত হিন্দুয়ানি তাহাকে এখনো মনে মনে আঘাত করিতেছিল। সে একরকম করিয়া বুঝিতে পারিতেছিল এই হিন্দুয়ানির মধ্যে একটা প্রতিকূলতার ভাব আছে–ইহা সহজ প্রশান্ত নহে, ইহা নিজের ভক্তি-বিশ্বাসের মধ্যে পর্যাপ্ত নহে, ইহা অন্যকে আঘাত করিবার জন্য সর্বদাই উগ্রভাবে উদ্যত।

সেদিন সন্ধ্যায় সকল কথায়, সকল কাজে, আহার করিবার কালে, লীলাকে গল্প বলিবার সময়, ক্রমাগতই সুচরিতার মনের তলদেশে একটা কিসের বেদনা কেবলই পীড়া দিতে লাগিল–তাহা কোনোমতেই সে দূর করিতে পারিল না। কাঁটা কোথায় আছে তাহা জানিতে পারিলে তবে কাঁটা তুলিয়া ফেলিতে পারা যায়। মনের কাঁটাটি খুঁজিয়া বাহির করিবার জন্য সেদিন রাত্রে সুচরিতা সেই গাড়িবারান্দার ছাতে একলা বসিয়া রহিল।

রাত্রির স্নিগ্ধ অন্ধকার দিয়া সে নিজের মনের অকারণ তাপ যেন মুছিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু কোনো ফল হইল না। তাহার বুকের অনির্দেশ্য বোঝাটার জন্য তাহার কাঁদিতে ইচ্ছা করিল, কিন্তু কান্না আসিল না।

একজন অপরিচিত যুবা কপালে তিলক কাটিয়া আসিয়াছে, অথবা তাহাকে তর্কে পরাস্ত করিয়া তাহার অহংকার নত করা গেল না এইজন্যই সুচরিতা এতক্ষণ ধরিয়া পীড়া বোধ করিতেছে, ইহার অপেক্ষা অদ্ভুত হাস্যকর কিছুই হইতে পারে না। এই কারণটাকে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলিয়া মন হইতে সে বিদায় করিয়া দিল। তখন আসল কারণটা মনে পড়িল এবং মনে পড়িয়া তাহার ভারি লজ্জা বোধ হইল। আজ তিন-চার ঘন্টা সুচরিতা সেই যুবকের সম্মুখেই বসিয়া ছিল এবং মাঝে মাঝে তাহার পক্ষ অবলম্বন করিয়া তর্কেও যোগ দিয়াছে অথচ সে তাহাকে একেবারে যেন লক্ষ্যমাত্রই করে নাই–যাইবার সময়েও তাহাকে সে যেন চোখে দেখিতেই পাইল না। এই পরিপূর্ণ উপেক্ষাই যে সুচরিতাকে গভীরভাবে বিঁধিয়াছে তাহাতে কোনো সন্দেহ নাই। বাহিরের মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার অভ্যাসটা থাকিলে যে একটা সংকোচ জন্মে, বিনয়ের ব্যবহারে যে একটি সংকোচের পরিচয় পাওয়া যায়– সেই সংকোচের মধ্যে একটা সলজ্জ নম্রতা আছে। গোরার আচরণে তাহার চিহ্নমাত্রও ছিল না। তাহার সেই কঠোর এবং প্রবল ঔদাসীন্য সহ্য করা বা তাহাকে অবজ্ঞা করিয়া উড়াইয়া দেওয়া সুচরিতার পক্ষে আজ কেন এমন অসম্ভব হইয়া উঠিল? এতবড়ো উপেক্ষার সম্মুখেও সে যে আত্মসংবরণ না করিয়া তর্কে যোগ দিয়াছিল, নিজের এই প্রগল্‌ভতায় সে যেন মরিয়া যাইতেছিল। হারানের অন্যায় তর্কে একবার যখন সুচরিতা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া উঠিয়াছিল তখন গোরা তাহার মুখের দিকে চাহিয়াছিল; সে চাহনিতে সংকোচের লেশমাত্র ছিল না– কিন্তু সে চাহনির ভিতর কী ছিল তাহাও বোঝা শক্ত। তখন কি সে মনে মনে বলিতেছিল– এ মেয়েটি কী নির্লজ্জ, অথবা, ইহার অহংকার তো কম নয়, পুরুষমানুষের তর্কে এ অনাহূত যোগ দিতে আসে? তাহাই যদি সে মনে করিয়া থাকে তাহাতে কী আসে যায়? কিছুই আসে যায় না, তবু সুচরিতা অত্যন্ত পীড়া বোধ করিতে লাগিল। এ-সমস্তই ভুলিয়া যাইতে, মুছিয়া ফেলিতে সে একান্ত চেষ্টা করিল কিন্তু কোনোমতেই পারিল না। গোরার উপর তাহার রাগ হইতে লাগিল– গোরাকে সে কুসংস্কারাচ্ছন্ন উদ্ধত যুবক বলিয়া সমস্ত মনের সঙ্গে অবজ্ঞা করিতে চাহিল কিন্তু তবু সেই বিপুলকায় বজ্রকণ্ঠ পুরুষের সেই নিঃসংকোচ দৃষ্টির স্মৃতির সম্মুখে সুচরিতা মনে মনে অত্যন্ত ছোটো হইয়া গেল– কোনোমতেই সে নিজের গৌরব খাড়া করিয়া রাখিতে পারিল না।

সকলের বিশেষ লক্ষগোচর হওয়া, আদর পাওয়া সুচরিতার অভ্যস্ত হইয়া গিয়াছিল। সে যে মনে মনে এই আদর চাহিত তাহা নহে, কিন্তু আজ গোরার নিকট হইতে উপেক্ষা কেন তাহার কাছে এত অসহ্য হইল? অনেক ভাবিয়া সুচরিতা শেষকালে স্থির করিল যে, গোরাকে সে বিশেষ করিয়া হার মানাইতে ইচ্ছা করিয়াছিল বলিয়াই তাহার অবিচলিত অনবধান এত করিয়া হৃদয়ে আঘাত করিতেছে।

এমনি করিয়া নিজের মনখানা লইয়া টানাছেঁড়া করিতে করিতে রাত্রি বাড়িয়া যাইতে লাগিল। বাতি নিবাইয়া দিয়া বাড়ির সকলেই ঘুমাইতে গিয়াছে। সদর-দরজা বন্ধ হইবার শব্দ হইল– বোঝা গেল বেহারা রান্না-খাওয়া সারিয়া এইবার শুইতে যাইবার উপক্রম করিতেছে। এমন সময় ললিতা তাহার রাত্রির কাপড় পরিয়া ছাতে আসিল। সুচরিতাকে কিছুই না বলিয়া তাহার পাশ দিয়া গিয়া ছাতের এক কোণে রেলিং ধরিয়া দাঁড়াইল। সুচরিতা মনে মনে একটু হাসিল, বুঝিল ললিতা তাহার প্রতি অভিমান করিয়াছে। আজ যে তাহার ললিতার সঙ্গে শুইবার কথা ছিল তাহা সে একেবারেই ভুলিয়া গিয়াছে। কিন্তু ভুলিয়া গেছি বলিলে ললিতার কাছে অপরাধ ক্ষালন হয় না– কারণ, ভুলিতে পারাটাই সকলের চেয়ে গুরুতর অপরাধ। সে যে যথাসময়ে প্রতিশ্রুতি মনে করাইয়া দিবে তেমন মেয়ে নয়। এতক্ষণ সে শক্ত হইয়া বিছানায় পড়িয়াছিল– যতই সময় যাইতেছিল ততই তাহার অভিমান তীব্র হইয়া উঠিতেছিল। অবশেষে যখন নিতান্তই অসহ্য হইয়া উঠিল তখন সে বিছানা ছাড়িয়া কেবল নীরবে জানাইতে আসিল যে আমি এখনো জাগিয়া আছি।

0 Shares