গোরা

মহিম। নিজের মেয়ে যদি থাকত তো বুঝতে কেন ব্যস্ত হচ্ছি। বছর গেলেই বয়েস আপনি বাড়ে কিন্তু পাত্র তো আপনি আসে না। কাজেই দিন যত যায় মন ততই ব্যাকুল হয়ে ওঠে। এখন, তুমি যদি একটু আশ্বাস দাও তা হলে নাহয় দু-দিন সবুর করতেও পারি।

বিনয়। আমার তো বেশি লোকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় নেই– কলকাতার মধ্যে আপনাদের বাড়ি ছাড়া আর-কোনো বাড়ি জানি নে বললেই হয়– তবু আমি খোঁজ করে দেখব।

মহিম। শশিমুখীর স্বভাবচরিত্র তো জান।

বিনয়। জানি বৈকি। ওকে এতটুকু বেলা থেকে দেখে আসছি– লক্ষ্ণী মেয়ে।

মহিম। তবে আর বেশিদূর খোঁজ করবার কী দরকার বাপু? ও মেয়ে তোমারই হাতে সমর্পণ করব।

বিনয় ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া কহিল, “বলেন কী?”

মহিম। কেন, অন্যায় কী বলেছি! অবশ্য, কুলে তোমরা আমাদের চেয়ে অনেক বড়ো– কিন্তু বিনয়, এত পড়াশুনা করে যদি তোমরা কুল মানবে তবে হল কী!

বিনয়। না, না, কুলের কথা হচ্ছে না, কিন্তু বয়েস যে–

মহিম। বল কী! শশীর বয়েস কম কী হল! হিঁদুর ঘরের মেয়ে তো মেম-সাহেব নয়– সমাজকে তো উড়িয়ে দিলে চলে না।

মহিম সহজে ছাড়িবার পাত্র নহেন– বিনয়কে তিনি অস্থির করিয়া তুলিলেন। অবশেষে বিনয় কহিল, “আমাকে একটু ভাববার সময় দিন।”

মহিম। আমি তো আজ রাত্রেই দিন স্থির করছি নে।

বিনয়। তবু বাড়ির লোকদের–

মহিম। হাঁ, সে তো বটেই। তাঁদের মত নিতে হবে বৈকি। তোমার খুড়োমশায় যখন বর্তমান আছেন তাঁর অমতে তো কিছু হতে পারে না।

এই বলিয়া পকেট হইতে দ্বিতীয় পানের দোনা নিঃশেষ করিয়া যেন কথাটা পাকাপাকি হইয়া আসিয়াছে এইরূপ ভাব করিয়া মহিম চলিয়া গেলেন।

কিছুদিন পূর্বে আনন্দময়ী একবার শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহের প্রস্তাব আভাসে উত্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু বিনয় তাহা কানেও তোলে নাই। আজও প্রস্তাবটা যে বিশেষ সংগত বোধ হইল তাহা নহে কিন্তু তবু কথাটা মনের মধ্যে একটুখানি যেন স্থান পাইল। বিনয়ের মনে হইল এই বিবাহ ঘটিলে আত্মীয়তা-সম্বন্ধে গোরা তাহাকে কোনোদিন ঠেলিতে পারিবে না। বিবাহ-ব্যাপারটাকে হৃদয়াবেগের সঙ্গে জড়িত করাকে ইংরেজিয়ানা বলিয়াই সে এতদিন পরিহাস করিয়া আসিয়াছে, তাই শশিমুখীকে বিবাহ করাটা তাহার কাছে অসম্ভব বলিয়া বোধ হইল না। মহিমের এই প্রস্তাব লইয়া গোরার সঙ্গে পরামর্শ করিবার যে একটা উপলক্ষ জুটিল আপাতত ইহাতেই সে খুশি হইল। বিনয়ের ইচ্ছা গোরা এই লইয়া তাহাকে একটু পীড়াপীড়ি করে। মহিমকে সহজে সম্মতি না দিলে মহিম গোরাকে দিয়া তাহাকে অনুরোধ করাইবার চেষ্টা করিবে ইহাতে বিনয়ের সন্দেহ ছিল না।

এই সমস্ত আলোচনা করিয়া বিনয়ের মনের অবসাদ কাটিয়া গেল। সে তখনই গোরার বাড়ি যাইবার জন্য প্রস্তুত হইয়া চাদর কাঁধে বাহির হইয়া পড়িল। অল্প একটু দূর যাইতেই পশ্চাৎ হইতে শুনিতে পাইল, “বিনয়বাবু।” পিছন ফিরিয়া দেখিল সতীশ তাহাকে ডাকিতেছে।

সতীশকে সঙ্গে লইয়া আবার বিনয় বাসায় প্রবেশ করিল। সতীশ পকেট হইতে রুমালের পুঁটুলি বাহির করিয়া কহিল, “এর মধ্যে কী আছে বলুন দেখি।”

বিনয় “মড়ার মাথা” “কুকুরের বাচ্ছা” প্রভৃতি নানা অসম্ভব জিনিসের নাম করিয়া সতীশের নিকট তর্জন লাভ করিল। তখন সতীশ তাহার রুমাল খুলিয়া গোটাপাঁচেক কালো কালো ফল বাহির করিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কী বলুন দেখি।”

বিনয় যাহা মুখে আসিল তাহাই বলিল। অবশেষে পরাভব স্বীকার করিলে সতীশ কহিল, রেঙ্গুনে তাহার এক মামা আছেন তিনি সেখানকার এই ফল তাহার মা’র কাছে পাঠাইয়া দিয়াছেন– মা তাহারই পাঁচটা বিনয়বাবুকে উপহার পাঠাইয়াছেন।

ব্রহ্মদেশের ম্যাঙ্গোষ্টিন ফল তখনকার দিনে কলিকাতায় সুলভ ছিল না– তাই বিনয় ফলগুলি নাড়িয়া চাড়িয়া টিপিয়া টুপিয়া কহিল, “সতীশবাবু, ফলগুলো খাব কী করে?”

সতীশ বিনয়ের এই অজ্ঞতায় হাসিয়া কহিল, “দেখবেন, কামড়ে খাবেন না যেন– ছুরি দিয়ে কেটে খেতে হয়।”

সতীশ নিজেই এই ফল কামড় দিয়া খাইবার নিষ্ফল চেষ্টা করিয়া আজ কিছুক্ষণ পূর্বে আত্মীয়স্বজনদের কাছে হাস্যাস্পদ হইয়াছে– সেইজন্য বিনয়ের অনভিজ্ঞতায় বিজ্ঞজনোচিত হাস্য করিয়া তাহার মনের বেদনা দূর হইল।

তাহার পরে দুই অসমবয়সী বন্ধুর মধ্যে কিছুক্ষণ কৌতুকালাপ হইলে পর সতীশ কহিল, “বিনয়বাবু, মা বলেছেন আপনার যদি সময় থাকে তো একবার আমাদের বাড়ি আসতে হবে– আজ লীলার জন্মদিন।”

বিনয় বলিল, “আজ ভাই, আমার সময় হবে না, আজ আমি আর-এক জায়গায় যাচ্ছি।”

সতীশ। কোথায় যাচ্ছেন?

বিনয়। আমার বন্ধুর বাড়িতে।

সতীশ। আপনার সেই বন্ধু?

বিনয়। হাঁ।

“বন্ধুর বাড়ি যেতে পারেন অথচ আমাদের বাড়ি যাবেন না’ ইহার যৌক্তিকতা সতীশ বুঝিতে পারিল না– বিশেষত বিনয়ের এই বন্ধুকে সতীশের ভালো লাগে নাই; সে যেন ইস্কুলের হেড মাস্টারের চেয়ে কড়া লোক, তাহাকে আর্গিন শুনাইয়া কেহ যশ লাভ করিবে সে এমন ব্যক্তিই নয়– এমন লোকের কাছে যাইবার জন্য বিনয় যে কিছুমাত্র প্রয়োজন অনুভব করিবে তাহা সতীশের কাছে ভালোই লাগিল না। সে কহিল, “না বিনয়বাবু, আপনি আমাদের বাড়ি আসুন।”

“আহ্বানসত্ত্বেও পরেশবাবুর বাড়িতে না গিয়া গোরার কাছে যাইব’ বিনয় এটা মনে মনে খুব আস্ফালন করিয়া বলিয়াছিল। আহত বন্ধুত্বের অভিমানকে আজ সে ক্ষুণ্ন হইতে দিবে না, গোরার প্রতি বন্ধুত্বের গৌরবকেই সে সকলের ঊর্ধ্বে রাখিবে ইহাই সে স্থির করিয়াছিল।

0 Shares