গোরা

কিন্তু হার মানিতে তাহার বেশিক্ষণ লাগিল না। দ্বিধা করিতে করিতে মনের মধ্যে আপত্তি করিতে করিতে অবশেষে বালকের হাত ধরিয়া সেই আটাত্তর নম্বরেরই পথে সে চলিল। বর্মা হইতে আগত দুর্লভ ফলের এক অংশ বিনয়কে মনে করিয়া পাঠানোতে যে আত্মীয়তা প্রকাশ পাইয়াছে তাহাকে খাতির না করা বিনয়ের পক্ষে অসম্ভব।

বিনয় পরেশবাবুর বাড়ির কাছাকাছি আসিয়া দেখিল পানুবাবু এবং আর-কয়েক জন অপরিচিত ব্যক্তি পরেশবাবুর বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিতেছে। লীলার জন্মদিনের মধ্যাহ্নভোজনে তাহারা নিমন্ত্রিত ছিল। পানুবাবু যেন বিনয়কে দেখিতে পান নাই এমনি ভাবে চলিয়া গেলেন।

বাড়িতে প্রবেশ করিয়াই বিনয় খুব একটা হাসির ধ্বনি এবং দৌড়াদৌড়ির শব্দ শুনিতে পাইল। সুধীর লাবণ্যর চাবি চুরি করিয়াছে; শুধু তাই নয়, দেরাজের মধ্যে লাবণ্যর খাতা আছে এবং সেই খাতার মধ্যে কবিযশঃপ্রার্থিনীর উপহাস্যতার উপকরণ আছে, তাহাই এই দস্যু লোকসমাজে উদ্‌ঘাটন করিবে বলিয়া শাসাইতেছে– ইহাই লইয়া উভয় পক্ষে যখন দ্বন্দ্ব চলিতেছে এমন সময়ে রঙ্গভূমিতে বিনয় প্রবেশ করিল।

তাহাকে দেখিয়া লাবণ্যের দল মুহূর্তের মধ্যে অন্তর্ধান করিল। সতীশ তাহাদের কৌতুকের ভাগ লইবার জন্য তাহাদের পশ্চাতে ছুটিল। কিছুক্ষণ পরে সুচরিতা ঘরে প্রবেশ করিয়া কহিল, “মা আপনাকে একটু বসতে বললেন, এখনই তিনি আসছেন। বাবা অনাথবাবুদের বাড়ি গেছেন, তাঁরও আসতে দেরি হবে না।”

সুচরিতা বিনয়ের সংকোচ ভাঙিয়া দিবার জন্য গোরার কথা তুলিল। হাসিয়া কহিল, “তিনি বোধ হয় আমাদের এখানে আর কখনো আসবেন না?”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “কেন?”

সুচরিতা কহিল, “আমরা পুরুষদের সামনে বেরোই দেখে তিনি নিশ্চয় অবাক হয়ে গেছেন। ঘরকরনার মধ্যে ছাড়া মেয়েদের আর কোথাও দেখলে তিনি বোধ হয় তাদের শ্রদ্ধা করতে পারেন না।”

বিনয় ইহার উত্তর দিতে কিছু মুশকিলে পড়িয়া গেল। কথাটার প্রতিবাদ করিতে পারিলেই সে খুশি হইত, কিন্তু মিথ্যা বলিবে কী করিয়া? বিনয় কহিল, “গোরার মত এই যে, ঘরের কাজেই মেয়েরা সম্পূর্ণ মন না দিলে তাদের কর্তব্যের একাগ্রতা নষ্ট হয়।”

সুচরিতা কহিল, “তা হলে মেয়েপুরুষে মিলে ঘরবাহিরকে একেবারে ভাগ করে নিলেই তো ভালো হত। পুরুষকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হয় বলে তাঁদের বাইরের কর্তব্য হয়তো ভালো করে সম্পন্ন হয় না। আপনিও আপনার বন্ধুর মতে মত দেন না কি?”

নারীনীতি সম্বন্ধে এ-পর্যন্ত তো বিনয় গোরার মতেই মত দিয়া আসিয়াছিল। ইহা লইয়া সে কাগজে লেখালেখিও করিয়াছে। কিন্তু সেইটেই যে বিনয়ের মত, এখন তাহা তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতে চাহিল না। সে কহিল, “দেখুন, আসলে এ-সকল বিষয়ে আমরা অভ্যাসের দাস। সেইজন্যেই মেয়েদের বাইরে বেরোতে দেখলে মনে খটকা লাগে– অন্যায় বা অকর্তব্য বলে যে খারাপ লাগে সেটা কেবল আমরা জোর করে প্রমাণ করতে চেষ্টা করি। যুক্তিটা এ স্থলে উপলক্ষ মাত্র, সংস্কারটাই আসল।”

সুচরিতা কহিল, “আপনার বন্ধুর মনে বোধ হয় সংস্কারগুলো খুব দৃঢ়।”

বিনয়। বাইরে থেকে দেখে হঠাৎ তাই মনে হয়। কিন্তু একটা কথা আপনি মনে রাখবেন আমাদের দেশের সংস্কারগুলিতে তিনি যে চেপে ধরে থাকেন, তার কারণ এ নয় যে সেই সংস্কারগুলিকেই তিনি শ্রেয় মনে করেন। আমরা দেশের প্রতি অন্ধ অশ্রদ্ধাবশত দেশের সমস্ত প্রথাকে অবজ্ঞা করতে বসেছিলুম বলেই তিনি এই প্রলয়কার্যে বাধা দিতে দাঁড়িয়েছেন। তিনি বলেন, আগে আমাদের দেশকে শ্রদ্ধার দ্বারা, প্রীতর দ্বারা সমগ্রভাবে পেতে হবে, জানতে হবে, তার পরে আপনিই ভিতর থেকে স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের নিয়মে সংশোধনের কাজ চলবে।

সুচরিতা কহিল, “আপনিই যদি হত তা হলে এতদিন হয় নি কেন?”

বিনয়। হয় নি তার কারণ, ইতিপূর্বে দেশ বলে আমাদের সমস্ত দেশকে, জাতি বলে আমাদের সমস্ত জাতিকে এক করে দেখতে পারি নি। তখন যদি বা আমাদের স্বজাতিকে অশ্রদ্ধা করি নি তেমনি শ্রদ্ধাও করি নি– অর্থাৎ তাকে লক্ষ্যই করা যায় নি– সেইজন্যেই তার শক্তি জাগে নি। এক সময়ে রোগীর দিকে না তাকিয়ে তাকে বিনা চিকিৎসায় বিনা পথ্যে ফেলে রাখা হয়েছিল– এখন তাকে ডাক্তারখানায় আনা হয়েছে বটে, কিন্তু ডাক্তার তাকে এতই অশ্রদ্ধা করে যে, একে একে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে ফেলা ছাড়া আর কোনো দীর্ঘ শুশ্রুষাসাধ্য চিকিৎসা সম্বন্ধে সে ধৈর্য ধরে বিচার করে না। এই সময়ে আমার বন্ধু ডাক্তারটি বলছেন আমার এই পরমাত্মীয়টিকে যে চিকিৎসার চোটে আগাগোড়া নিঃশেষ করে ফেলবে এ আমি সহ্য করতে পারব না। এখন আমি এই ছেদনকার্য একেবারেই বন্ধ করে দেব এবং অনুকূল পথ্য-দ্বারা আগে এর নিজের ভিতরকার জীবনীশক্তিকে জাগিয়ে তুলব, তার পরে ছেদন করলেও রোগী সইতে পারবে, ছেদন না করলেও হয়তো রোগী সেরে উঠবে। গোরা বলেন, গভীর শ্রদ্ধাই আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থায় সকলের চেয়ে বড়ো পথ্য– এই শ্রদ্ধার অভাবেই আমরা দেশকে সমগ্রভাবে জানতে পারছি নে– জানতে পারছি নে বলেই তার সম্বন্ধে যা ব্যবস্থা করছি তা কুব্যবস্থা হয়ে উঠছে। দেশকে ভালো না বাসলে তাকে ভালো করে জানবার ধৈর্য থাকে না, তাকে না জানলে তার ভালো করতে চাইলেও তার ভালো করা যায় না।

সুচরিতা একটু একটু করিয়া খোঁচা দিয়া দিয়া গোরার সম্বন্ধে আলোচনাকে নিবিতে দিল না। বিনয়ও গোরার পক্ষে তাহার যাহা-কিছু বলিবার তাহা খুব ভালো করিয়াই বলিতে লাগিল। এমন যুক্তির কথা এমন দৃষ্টান্ত দিয়া এমন গুছাইয়া আর কখনো যেন সে বলে নাই; গোরাও তাহার নিজের মত এমন পরিষ্কার করিয়া এমন উজ্জ্বল করিয়া বলিতে পারিত কি না সন্দেহ; বিনয়ের বুদ্ধি ও প্রকাশক্ষমতার এই অপূর্ব উত্তেজনায় তাহার মনে একটা আনন্দ জন্মিতে লাগিল এবং সেই আনন্দে তাহার মুখ উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “দেখুন, শাস্ত্রে বলে, আত্মানং বিদ্ধি– আপনাকে জানো। নইলে মুক্তি কিছুতেই নেই। আমি আপনাকে বলছি, আমার বন্ধু গোরা ভারতবর্ষের সেই আত্মবোধের প্রকাশ রূপে আবির্ভূত হয়েছে। তাকে আমি সামান্য লোক বলে মনে করতে পারি নে। আমাদের সকলের মন যখন তুচ্ছ আকর্ষণে নূতনের প্রলোভনে বাহিরের দিকে ছড়িয়ে পড়েছে তখন ঐ একটিমাত্র লোক এই-সমস্ত বিক্ষিপ্ততার মাঝখানে অটলভাবে দাঁড়িয়ে সিংহগর্জনে সেই পুরাতন মন্ত্র বলছে– আত্মানাং বিদ্ধি।”

0 Shares