গোরা

বিনয় কহিল, “না, মা!”

আনন্দময়ী। তোমাকে এইখানেই খেতে হবে।

বিনয় একবার গোরার মুখের দিকে চাহিল। গোরা কহিল, “বিনয়, অনেক দিন বাঁচবে। তোমার ওখানেই যাচ্ছিলুম।”

আনন্দময়ীর বুক হালকা হইয়া গেল– তিনি তাড়াতাড়ি নীচে চলিয়া গেলেন।

দুই বন্ধু ঘরে আসিয়া বসিলে গোরা যাহা-তাহা একটা কথা তুলিল– কহিল, “জান, আমাদের ছেলেদের জন্যে একজন বেশ ভালো জিমনাষ্টিক মাস্টার পেয়েছি। সে শেখাচ্ছে বেশ।”

মনের ভিতরের আসল কথাটা এখনো কেহ পাড়িতে সাহস করিল না।

দুই জনে যখন খাইতে বসিয়া গেল তখন আনন্দময়ী তাহাদের কথাবার্তায় বুঝিতে পারিলেন এখনো তাহাদের উভয়ের মধ্যে বাধো-বাধো রহিয়াছে। পর্দা উঠিয়া যায় নাই। তিনি কহিলেন, “বিনয়, রাত অনেক হয়েছে, তুমি আজ এইখানেই শুয়ো। আমি তোমার বাসায় খবর পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

বিনয় চকিতের মধ্যে গোরার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “ভুক্‌ত্‌বা রাজবদাচরেৎ। খেয়ে রাস্তায় হাঁটা নিয়ম নয়। তা হলে এইখানেই শোয়া যাবে।”

আহারান্তে দুই বন্ধু ছাতে আসিয়া মাদুর পাতিয়া বসিল। ভাদ্রমাস পড়িয়াছে; শুক্লপক্ষের জ্যোৎস্নায় আকাশ ভাসিয়া যাইতেছে। হালকা পাতলা সাদা মেঘ ক্ষণিক ঘুমের ঘোরের মতো মাঝে মাঝে চাঁদকে একটুখানি ঝাপসা করিয়া দিয়া আস্তে আস্তে উড়িয়া চলিতেছে। চারি দিকে দিগন্ত পর্যন্ত নানা আয়তনের উঁচু নিচু ছাদের শ্রেণী ছায়াতে আলোতে এবং মাঝে মাঝে গাছের মাথার সঙ্গে মিশিয়া যেন সম্পূর্ণ প্রয়োজনহীন একটা প্রকাণ্ড অবাস্তব খেয়ালের মতো পড়িয়া রহিয়াছে।

গির্জার ঘড়িতে এগারোটার ঘণ্টা বাজিল; বরফওয়ালা তাহার শেষ হাঁক হাঁকিয়া চলিয়া গেল। গাড়ির শব্দ মন্দ হইয়া আসিয়াছে। গোরাদের গলিতে জাগরণের লক্ষণ নাই, কেবল প্রতিবেশীর আস্তাবলে কাঠের মেঝের উপর ঘোড়ার খুরের শব্দ এক-এক বার শোনা যাইতেছে এবং কুকুর ঘেউ ঘেউ করিয়া উঠিতেছে।

দুই জনে অনেকক্ষণ চুপ করিয়া রহিল। তাহার পরে বিনয় প্রথমটা একটু দ্বিধা করিয়া অবশেষে পরিপূর্ণবেগে তাহার মনের কথাকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিল। বিনয় কহিল, “ভাই গোরা, আমার বুক ভরে উঠেছে। আমি জানি এ-সব বিষয়ে তোমার মন নেই, কিন্তু তোমাকে না বললে আমি বাঁচব না। আমি ভালো মন্দ কিছুই বুঝতে পারছি নে– কিন্তু এটা নিশ্চয় এর সঙ্গে কোনো চাতুরী খাটবে না। বইয়েতে অনেক কথা পড়েছি এবং এতদিন মনে করে এসেছি সব জানি। ঠিক যেন ছবিতে জল দেখে মনে করতুম সাঁতার দেওয়া খুব সহজ– কিন্তু আজ জলের মধ্যে পড়ে এক মুহূর্তে বুঝতে পেরেছি, এ তো ফাঁকি নয়।”

এই বলিয়া বিনয় তাহার জীবনের এই আশ্চর্য আবির্ভাবকে একান্ত চেষ্টায় গোরার সম্মুখে উদ্‌ঘাটিত করিতে লাগিল।

বিনয় বলিতে লাগিল, আজকাল তাহার কাছে সমস্ত দিন ও রাত্রির মধ্যে কোথাও যেন কিছু ফাঁক নাই– সমস্ত আকাশের মধ্যে কোথাও যেন কোনো রন্ধ্র নাই, সমস্ত একেবারে নিবিড়ভাবে ভরিয়া গেছে– বসন্তকালের মউচাক যেমন মধুতে ভরিয়া ফাটিয়া যাইতে চায়, তেমনিতরো। আগে এই বিশ্বচরাচরের অনেকখানি তাহার জীবনের বাহিরে পড়িয়া থাকিত। যেটুকুতে তাহার প্রয়োজন সেইটুকুতেই তাহার দৃষ্টি বদ্ধ ছিল। আজ সমস্তই তাহার সম্মুখে আসিতেছে, সমস্তই তাহাকে স্পর্শ করিতেছে, সমস্তই একটা নূতন অর্থে পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে। সে জানিত না পৃথিবীকে সে এত ভালোবাসে, আকাশ এমন আশ্চর্য, আলোক এমন অপূর্ব, রাস্তার অপরিচিত পথিকের প্রবাহও এমন গভীরভাবে সত্য। তাহার ইচ্ছা করে সকলের জন্য সে একটা-কিছু করে, তাহার সমস্ত শক্তিকে আকাশের সূর্যের মতো সে জগতের চিরন্তন সামগ্রী করিয়া তোলে।

বিনয় যে কোনো ব্যক্তিবিশেষের প্রসঙ্গে এই-সমস্ত কথা বলিতেছে তাহা হঠাৎ মনে হয় না। সে যেন কাহারো নাম মুখে আনিতে পারে না– আভাস দিতে গেলেও কুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। এই-যে আলোচনা করিতেছে ইহার জন্য সে যেন কাহার প্রতি অপরাধ অনুভব করিতেছে। ইহা অন্যায়, ইহা অপমান– কিন্তু আজ এই নির্জন রাত্রে নিস্তব্ধ আকাশে বন্ধুর পাশে বসিয়া এ অন্যায়টুকু সে কোনোমতেই কাটাইতে পারিল না।

সে কী মুখ! প্রাণের আভা তাহার কপোলের কোমলতার মধ্যে কী সুকুমার ভাবে প্রকাশ পাইতেছে! হাসিতে তাহার অন্তঃকরণ কী আশ্চর্য আলোর মতো ফুটিয়া পড়ে! ললাটে কী বুদ্ধি! এবং ঘন পল্লবের ছায়াতলে দুই চক্ষুর মধ্যে কী নিবিড় অনির্বচনীয়তা! আর সেই দুটি হাত– সেবা এবং স্নেহকে সৌন্দর্যে সার্থক করিবার জন্য প্রস্তুত হইয়া আছে, সে যেন কথা কহিতেছে। বিনয় নিজের জীবনকে যৌবনকে ধন্য জ্ঞান করিতেছে, এই আনন্দে তাহার বুকের মধ্যে যেন ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছে। পৃথিবীর অধিকাংশ লোকই যাহা না দেখিয়াই জীবন সাঙ্গ করে– বিনয় যে তাহাকে এমন করিয়া চোখের সামনে মূর্তিমান দেখিতে পাইবে ইহার চেয়ে আশ্চর্য কিছুই নাই।

কিন্তু এ কী পাগলামি! এ কী অন্যায়। হোক অন্যায়, আর তো ঠেকাইয়া রাখা যায় না। এই স্রোতেই যদি কোনো একটা কূলে তুলিয়া দেয় তো ভালো, আর যদি ভাসাইয়া দেয়, যদি তলাইয়া লয় তবে উপায় কী! মুশকিল এই যে, উদ্ধারের ইচ্ছাও হয় না– এতদিনকার সমস্ত সংস্কার, সমস্ত স্থিতি হারাইয়া চলিয়া যাওয়াই যেন জীবনের সার্থক পরিণাম।

গোরা চুপ করিয়া শুনিতে লাগিল। এই ছাতে এমনি নির্জন নিষুপ্ত জ্যোৎস্নারাত্রে আরো অনেক দিন দুইজনে অনেক কথা হইয়া গেছে– কত সাহিত্য, কত লোকচরিত্র কত সমাজহিতের আলোচনা, ভবিষ্যৎ জীবনযাত্রা সম্বন্ধে দুইজনের কত সংকল্প। কিন্তু এমন কথা ইহার পূর্বে আর কোনোদিন হয় নাই। মানবহৃদয়ের এমন একটা সত্য পদার্থ, এমন একটা প্রবল প্রকাশ এমন করিয়া গোরার সামনে আসিয়া পড়ে নাই। এই-সমস্ত ব্যাপারকে সে এতদিন কবিত্বের আবর্জনা বলিয়া সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আসিয়াছে– আজ সে ইহাকে এত কাছে দেখিল যে ইহাকে আর অস্বীকার করিতে পারিল না। শুধু তাহাই নয়, ইহার বেগ তাহার মনকে ঠেলা দিল, ইহার পুলক তাহার সমস্ত শরীরের মধ্যে বিদ্যুতের মতো খেলিয়া গেল। তাহার যৌবনের একটা অগোচর অংশের পর্দা মুহূর্তের জন্য হাওয়ায় উড়িয়া গেল এবং সেই এতদিনকার রুদ্ধ কক্ষে এই শরৎ-নিশীথের জ্যোৎস্না প্রবেশ করিয়া একটা মায়া বিস্তার করিয়া দিল।

0 Shares