গোরা

যাহা হউক, হারানবাবু যতদিন নিজেকে সুচরিতার ভক্তির পাত্র বলিয়া জ্ঞান করিতেন ততদিন তাহার ছোটোখাটো কাজ ও আচরণ লইয়া কেবল সমালোচনা করিয়াছেন এবং তাহাকে সর্বদা উপদেশ দিয়া গড়িয়া তুলিতেই প্রবৃত্ত ছিলেন– বিবাহ সম্বন্ধে কোনো কথা স্পষ্ট করিয়া উত্থাপন করেন নাই। সেদিন সুচরিতার দুই-একটি কথা শুনিয়া যখন হঠাৎ তিনি বুঝিতে পারিলেন সেও তাঁহাকে বিচার করিতে আরম্ভ করিয়াছে, তখন হইতে অবিচলিত গাম্ভীর্য ও স্থৈর্য রক্ষা করা তাঁহার পক্ষে কঠিন হইয়া উঠিয়াছে। ইতিমধ্যে যে দুই-একবার সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার দেখা হইয়াছে পূর্বের ন্যায় নিজের গৌরব তিনি অনুভব ও প্রকাশ করিতে পারেন নাই। সুচরিতার সঙ্গে তাঁহার কথায় ও আচরণে একটা কলহের ভাব দেখা দিয়াছে। তাহাকে লইয়া অকারণে বা ছোটো ছোটো উপলক্ষ ধরিয়া খুঁতখুঁত করিয়াছেন। তৎসত্ত্বেও সুচরিতার অবিচলিত ঔদাসীন্যে তাঁহাকে মনে মনে হার মানিতে হইয়াছে এবং নিজের মর্যাদাহানিতে বাড়িতে আসিয়া পরিতাপ করিয়াছেন।

যাহা হউক, সুচরিতার শ্রদ্ধাহীনতার দুই-একটা লক্ষণ দেখিয়া হারানবাবুর পক্ষে তাঁহার পরীক্ষকের উচ্চ আসনে দীর্ঘকাল স্থির হইয়া বসিয়া থাকা শক্ত হইয়া উঠিল। পূর্বে এত ঘন ঘন পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করিতেন না– সুচরিতার প্রেমে তিনি চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছেন, পাছে তাঁহাকে এইরূপ কেহ সন্দেহ করে এই আশঙ্কায় তিনি সপ্তাহে কেবল একবার করিয়া আসিতেন এবং সুচরিতা যেন তাঁহার ছাত্রী এমনিভাবে নিজের ওজন রাখিয়া চলিতেন। কিন্তু এই কয়দিন হঠাৎ কী হইয়াছে– হারানবাবু তুচ্ছ একটা ছুতা লইয়া দিনে একাধিক বারও আসিয়াছেন এবং ততোধিক তুচ্ছ ছুতা ধরিয়া সুচরিতার সঙ্গে গায়ে পড়িয়া আলাপ করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। পরেশবাবুও এই উপলক্ষে উভয়কে ভালো করিয়া পর্যবেক্ষণ করিবার অবকাশ পাইয়াছেন এবং তাঁহার সন্দেহও ক্রমে ঘনীভূত হইয়া আসিতেছে।

আজ হারানবাবু আসিতেই বরদাসুন্দরী তাঁহাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিলেন, “আচ্ছা, পানুবাবু, আপনি আমাদের সুচরিতাকে বিবাহ করবেন এই কথা সকলেই বলে, কিন্তু আপনার মুখ থেকে তো কোনোদিন কোনো কথা শুনতে পাই নে। যদি সত্যিই আপনার এরকম অভিপ্রায় থাকে তা হলে স্পষ্ট করে বলেন না কেন?”

হারানবাবু আর বিলম্ব করিতে পারিলেন না। এখন সুচরিতাকে তিনি কোনোমতে বন্দী করিতে পারিলেই নিশ্চিন্ত হন– তাঁহার প্রতি ভক্তি ও ব্রাহ্মসমাজের হিতকল্পে যোগ্যতার পরীক্ষা পরে করিলেও চলিবে। হারানবাবু বরদাসুন্দরীকে কহিলেন, “এ কথা বলা বাহুল্য বলেই বলি নি। সুচরিতার আঠারো বছর বয়সের জন্যই প্রতীক্ষা করছিলেম।”

বরদাসুন্দরী কহিলেন, “আপনার আবার একটু বাড়াবাড়ি আছে। আমরা তো চোদ্দ বছর হলেই যথেষ্ট মনে করি!”

সেদিন চা খাইবার সময় পরেশবাবু সুচরিতার ভাব দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া গেলেন। সুচরিতা হারানবাবুকে এত যত্ন-অভ্যর্থনা অনেক দিন করে নাই। এমন-কি, হারানবাবু যখন চলিয়া যাইবার উপক্রম করিতেছিলেন তখন তাঁহাকে লাবণ্যের নূতন একটা শিল্পকলার পরিচয় দিবার উপলক্ষে আরো একটু বসিয়া থাকিতে অনুরোধ করিয়াছিল।

পরেশবাবুর মন নিশ্চিন্ত হইল। তিনি ভাবিলেন, তিনি ভুল করিয়াছেন। এমন-কি,তিনি মনে মনে একটু হাসিলেন। ভাবিলেন, এই দুইজনের মধ্যে হয়তো নিগূঢ় একটা প্রণয়কলহ ঘটিয়াছিল, আবার সেটা মিটমাট হইয়া গেছে।

সেই দিন বিদায় হইবার সময় হারান পরেশবাবুর কাছে বিবাহের প্রস্তাব পাড়িলেন। জানাইলেন, এ সম্বন্ধে বিলম্ব করিতে তাঁহার ইচ্ছা নাই।

পরেশবাবু একটু আশ্চর্য হইয়া কহিলেন, “কিন্তু আপনি যে আঠারো বছরের কমে মেয়েদের বিয়ে হওয়া অন্যায় বলেন। এমন-কি, আপনি কাগজেও সে কথা লিখেছেন।”

হারানবাবু কহিলেন, “সুচরিতার সম্বন্ধে এ কথা খাটে না। কারণ, ওর মনের যেরকম পরিণতি হয়েছে অনেক বড়ো বয়সের মেয়েরও এমন দেখা যায় না।”

পরেশবাবু প্রশান্ত দৃঢ়তার সঙ্গে কহিলেন, “তা হোক পানুবাবু। যখন বিশেষ কোনো অহিত দেখা যাচ্ছে না তখন আপনার মত অনুসারে রাধারানীর বয়স পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাই কর্তব্য।”

হারানবাবু নিজের দুর্বলতা প্রকাশ হওয়ায় লজ্জিত হইয়া কহিলেন, “নিশ্চয়ই কর্তব্য। কেবল আমার ইচ্ছা এই যে, একদিন সকলকে ডেকে ঈশ্বরের নাম করে সম্বন্ধটা পাকা করা হোক।”

পরেশবাবু কহিলেন, “সে অতি উত্তম প্রস্তাব।”

১৭

ঘণ্টা দুই-তিন নিদ্রার পর যখন গোরা ঘুম ভাঙিয়া পাশে চাহিয়া দেখিল বিনয় ঘুমাইতেছে তখন তাহার হৃদয় আনন্দে ভরিয়া উঠিল। স্বপ্নে একটা প্রিয় জিনিস হারাইয়া জাগিয়া উঠিয়া যখন দেখা যায় তাহা হারায় নাই তখন যেমন আরাম বোধ হয় গোরার সেইরূপ হইল। বিনয়কে ত্যাগ করিলে গোরার জীবনে যে কতখানি পঙ্গু হইয়া পড়ে আজ নিদ্রাভঙ্গে বিনয়কে পাশে দেখিয়া তাহা সে অনুভব করিতে পারিল। এই আনন্দের আঘাতে চঞ্চল হইয়া গোরা ঠেলাঠেলি করিয়া বিনয়কে জাগাইয়া দিল এবং কহিল, “চলো, একটা কাজ আছে।”

গোরার প্রত্যহ সকালবেলায় একটা নিয়মিত কাজ ছিল। সে পাড়ার নিম্নশ্রেণীর লোকদের ঘরে যাতায়াত করিত। তাহাদের উপকার করিবার বা উপদেশ দিবার জন্য নহে– নিতান্তই তাহাদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যই যাইত। শিক্ষিত দলের মধ্যে তাহার এরূপ যাতায়াতের সম্বন্ধ ছিল না বলিলেই হয়। গোরাকে ইহারা দাদাঠাকুর বলিত এবং কড়িবাঁধা হুঁকা দিয়া অভ্যর্থনা করিত। কেবলমাত্র ইহাদের আতিথ্য গ্রহণ করিবার জন্যই গোরা জোর করিয়া তামাক খাওয়া ধরিয়াছিল।

0 Shares