গোরা

দেরাজ খুলিতেই পরেশবাবুর পরিবারের সকলের একত্রে তোলা একটা বড়ো ফোটোগ্রাফ সর্বাগ্রে চোখে পড়িল। এটি বিনয় তাহার বালক বন্ধু সতীশের নিকট হইতে সংগ্রহ করিয়াছিল।

টাকা সংগ্রহ করিয়া গোরা সেই মুসলমানকে বিদায় করিল, কিন্তু ফোটোগ্রাফ সম্বন্ধে কোনো কথাই বলিল না। গোরাকে এ সম্বন্ধে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিনয়ও কোনো কথা তুলিতে পারিল না– অথচ দুই-চারিটা কথা হইয়া গেলে বিনয়ের মন সুস্থ হইত।

গোরা হঠাৎ বলিল, “চললুম।”

বিনয় কহিল, “বাঃ, তুমি একলা যাবে কি! মা যে আমাকে তোমাদের ওখানে খেতে বলেছেন। অতএব আমিও চললুম।”

দুইজনে রাস্তায় বাহির হইয়া পড়িল। বাকি পথ গোরা আর কোনো কথা কহিল না। ডেস্কের মধ্যে ঐ ছবিখানি দেখিয়া গোরাকে আবার সহসা স্মরণ করাইয়া দিল যে, বিনয়ের চিত্তের একটা প্রধান ধারা এমন একটা পথে চলিয়াছে যে পথের সঙ্গে গোরার জীবনের কোনো সম্পর্ক নাই। ক্রমে বন্ধুত্বের আদিগঙ্গা নির্জীব হইয়া ঐ দিকেই মূল ধারাটা বহিতে পারে এ আশঙ্কা অব্যক্তভাবে গোরার হৃদয়ের গভীরতম তলদেশে একটা অনির্দেশ্য ভারের মতো চাপিয়া পড়িল। সমস্ত-চিন্তায় ও কর্মে এতদিন দুই বন্ধুর মধ্যে কোনো বিচ্ছেদ ছিল না– এখন আর তাহা রক্ষা করা কঠিন হইতেছে– বিনয় এক জায়গায় স্বতন্ত্র হইয়া উঠিতেছে।

গোরা যে কেন চুপ করিয়া গেল বিনয় তাহা বুঝিল। কিন্তু এই নীরবতার বেড়া গায়ে পড়িয়া ঠেলিয়া ভাঙিতে তাহার সংকোচ বোধ হইল। গোরার মনটা যে জায়গায় আসিয়া ঠেকিতেছে সেখানে একটা সত্যকার ব্যবধান আছে ইহা বিনয় নিজেও অনুভব করে।

বাড়িতে আসিয়া পৌঁছিতেই দেখা গেল মহিম পথের দিকে চাহিয়া দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া আছেন। দুই বন্ধুকে দেখিয়া তিনি কহিলেন, “ব্যাপারখানা কী! কাল তো তোমাদের সমস্ত রাত না ঘুমিয়েই কেটেছে– আমি ভাবছিলুম দুজনে বুঝি বা ফুটপাথের উপরে কোথাও আরামে ঘুমিয়ে পড়েছ! বেলা তো কম হয় নি। যাও বিনয়, নাইতে যাও।”

বিনয়কে তাগিদ করিয়া নাহিতে পাঠাইয়া মহিম গোরাকে লইয়া পড়িলেন; কহিলেন, “দেখো গোরা, তোমাকে যে কথাটা বলেছিলুম সেটা একটু বিবেচনা করে দেখো। বিনয়কে যদি তোমার অনাচারী বলে সন্দেহ হয় তা হলে আজকালকার বাজারে হিন্দু পাত্র পাব কোথায়? শুধু হিঁদুয়ানি হলেও তো চলবে না– লেখা-পড়াও তো চাই! ঐ লেখাপড়াতে হিঁদুয়ানিতে মিললে যে পদার্থটা হয় সেটা আমাদের হিন্দুমতে ঠিক শাস্ত্রীয় জিনিস নয় বটে, কিন্তু মন্দ জিনিসও নয়। যদি তোমার মেয়ে থাকত তা হলে এ বিষয়ে আমার সঙ্গে তোমার মতের ঠিক মিল হয়ে যেত।”

গোরা কহিল, “তা, বেশ তো– বিনয় বোধ হয় আপত্তি করবে না।”

মহিম কহিল, “শোনো একবার! বিনয়ের আপত্তির জন্য কে ভাবছে। তোমার আপত্তিকেই তো ডরাই। তুমি নিজের মুখে একবার বিনয়কে অনুরোধ করো, আমি আর কিছু চাই নে– তাতে যদি ফল না হয় তো না হবে।”

গোরা কহিল, “আচ্ছা।”

মহিম মনে মনে কহিল “এইবার ময়রার দোকানে সন্দেশ এবং গয়লার দোকানে দই-ক্ষীর ফরমাশ দিতে পারি।’

গোরা অবসরক্রমে বিনয়কে কহিল, “শশিমুখীর সঙ্গে তোমার বিবাহের জন্য দাদা ভারি পীড়াপীড়ি আরম্ভ করেছেন। এখন তুমি কী বল?”

বিনয়। আগে তোমার কী ইচ্ছা সেইটে বলো।

গোরা। আমি তো বলি মন্দ কী!

বিনয়। আগে তো তুমি মন্দই বলতে! আমরা দুজনের কেউ বিয়ে করব না এ তো একরকম ঠিক হয়েই ছিল।

গোরা। এখন ঠিক করা গেল তুমি বিয়ে করবে আর আমি করব না।

বিনয়। কেন, এক যাত্রায় পৃথক ফল কেন?

গোরা। পৃথক ফল হবার ভয়েই এই ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। বিধাতা কোনো কোনো মানুষকে সহজেই বেশি ভারগ্রস্ত করে গড়ে থাকেন, কেউ বা সহজেই দিব্য ভারহীন– এই উভয় জীবকে একত্রে জুড়ে চালাতে গেলে এদের একটির উপর বাইরে থেকে বোঝা চাপিয়ে দুজনের ওজন সমান করে নিতে হয়। তুমি বিবাহ করে একটু দায়গ্রস্ত হলে পর তোমার আমাতে সমান চালে চলতে পারব।

বিনয় একটু হাসিল এবং কহিল, “যদি সেই মতলব হয় তবে এই দিকেই বাটখারাটি চাপাও।”

গোরা। বাটখারাটি সম্বন্ধে আপত্তি নেই তো?

বিনয়। ওজন সমান করবার জন্যে যা হাতের কাছে আসে তাতেই কাজ চালানো যেতে পারে। ও পাথর হলেও হয়, ঢেলা হলেও হয়, যা খুশি।

গোরা যে বিবাহ-প্রস্তাবে কেন উৎসাহ প্রকাশ করিল তাহা বিনয়ের বুঝিতে বাকি রহিল না। পাছে বিনয় পরেশবাবুর পরিবারের মধ্যে বিবাহ করিয়া বসে গোরার মনে এই সন্দেহ হইয়াছে অনুমান করিয়া বিনয় মনে মনে হাসিল। এরূপ বিবাহের সংকল্প ও সম্ভাবনা তাহার মনে এক মুহূর্তের জন্যও উদিত হয় নাই। এ যে হইতেই পারে না। যাই হোক, শশিমুখীকে বিবাহ করিলে এরূপ অদ্ভুত আশঙ্কার একেবারে মূল উৎপাটিত হইয়া যাইবে এবং তাহা হইলেই উভয়ের বন্ধুত্বসম্বন্ধ পুনরায় সুস্থ ও শান্ত হইবে ও পরেশবাবুদের সঙ্গে মেলামেশা করিতেও তাহার কোনো দিক হইতে কোনো সংকোচের কারণ থাকিবে না, এই কথা চিন্তা করিয়া সে শশিমুখীর সহিত বিবাহে সহজেই সম্মতি দিল। মধ্যাহ্নে আহারান্তে রাত্রের নিদ্রার ঋণশোধ করিতে দিন কাটিয়া গেল। সেদিন দুই বন্ধুর মধ্যে আর কোনো কথা হইল না, কেবল জগতের উপর সন্ধ্যার অন্ধকার পর্দা পড়িলে প্রণয়ীদের মধ্যে যখন মনের পর্দা উঠিয়া যায় সেই সময় বিনয় ছাতের উপর বসিয়া সিধা আকাশের দিকে তাকাইয়া বলিল, “দেখো, গোরা, একটা কথা আমি তোমাকে বলতে চাই। আমার মনে হয় আমাদের স্বদেশপ্রেমের মধ্যে একটা গুরুতর অসম্পূর্ণতা আছে। আমরা ভারতবর্ষকে আধখানা করে দেখি।”

0 Shares