পরেশবাবু এতক্ষণ চুপ করিয়া শুনিতেছিলেন, তিনি ধীরে ধীরে বলিলেন, “ভারতবর্ষকে যে আমি জানি তা বলতে পারি নে এবং ভারতবর্ষ যে কী চেয়েছিলেন এবং কোনোদিন তা পেয়েছিলেন কি না তা আমি নিশ্চয় জানি নে, কিন্তু যে দিন চলে গেছে সেই দিনে কি কখনো ফিরে পাওয়া যায়? বর্তমানে যা সম্ভব তাই আমাদের সাধনার বিষয়–অতীতের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে সময় নষ্ট করলে কি কোনো কাজ হবে?”
বিনয় কহিল, “আপনি যেমন বলেছেন আমিও ঐরকম করে ভেবেছি এবং অনেক বার বলেওছি–গোরা বলে যে, অতীতকে বলে বরখাস্ত করে বসে আছি বলেই কি সে অতীত? বর্তমানের হাঁকডাকের আড়ালে পড়ে সে আমাদের দৃষ্টির অতীত হয়েছে বলেই অতীত নয়–সে ভারতবর্ষের মজ্জার মধ্যে রয়েছে। কোনো সত্য কোনোদিনই অতীত হতে পারে না। সেইজন্যই ভারতবর্ষের এই সত্য আমাদের আঘাত করতে আরম্ভ করেছে। একদিন একে যদি আমাদের একজনও সত্য বলে চিনতে ও গ্রহণ করতে পারে তা হলেই আমাদের শক্তির খনির দ্বারে প্রবেশের পথ খুলে যাবে–অতীতের ভাণ্ডার বর্তমানের সামগ্রী হয়ে উঠবে। আপনি কি মনে করছেন ভারতবর্ষের কোথাও সেরকম সার্থকজন্মা লোকের আবির্ভাব হয় নি?”
সুচরিতা কহিল, “আপনি যেরকম করে এ-সব কথা বলছেন ঠিক সাধারণ লোকে এরকম করে বলে না–সেইজন্যে আপনাদের মতকে সমস্ত দেশের জিনিস বলে ধরে নিতে মনে সংশয় হয়।”
বিনয় কহিল, “দেখুন, সূর্যের উদয় ব্যাপারটাকে বৈজ্ঞানিকেরা একরকম করে ব্যাখ্যা করে, আবার সাধারণ লোকে আর-এক রকম করে ব্যাখ্যা করে। তাতে সূর্যের উদয়ের বিশেষ কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি করে না। তবে কিনা সত্যকে ঠিকমতো করে জানার দরুন আমাদের একটা লাভ আছে। দেশের যে-সকল সত্যকে আমরা খণ্ডিত করে বিক্ষিপ্ত করে দেখি গোরা তার সমস্তকে এক করে সংশ্লিষ্ট করে দেখতে পায়, গোরার সেই আশ্চর্য ক্ষমতা আছে–কিন্তু সেইজন্যই কি গোরার সেই দেখাকে দৃষ্টিবিভ্রম বলে মনে করবেন? আর যারা ভেঙে চুরে দেখে তাদের দেখাটাই সত্য?”
সুচরিতা চুপ করিয়া রহিল। বিনয় কহিল, “আমাদের দেশে সাধারণত যে-সকল লোক নিজেকে পরম হিন্দু বলে অভিমান করে আমার বন্ধু গোরাকে আপনি সে দলের লোক বলে মনে করবেন না। আপনি যদি ওর বাপ কৃষ্ণদয়ালবাবুকে দেখতেন তা হলে বাপ ও ছেলের তফাত বুঝতে পারতেন। কৃষ্ণদয়ালবাবু সর্বদাই কাপড় ছেড়ে, গঙ্গাজল ছিটিয়ে, পাঁজিপুঁথি মিলিয়ে নিজেকে সুপবিত্র করে রাখবার জন্যে অহরহ ব্যস্ত হয়ে আছেন–রান্না সম্বন্ধে খুব ভালো বামুনকেও তিনি বিশ্বাস করেন না, পাছে তার ব্রাহ্মণত্বে কোথাও কোনো ত্রুটি থাকে–গোরাকে তাঁর ঘরের ত্রিসীমানায় ঢুকতে দেন না–কখনো যদি কাজের খাতিরে তাঁর স্ত্রীর মহলে আসতে হয়, তা হলে ফিরে গিয়ে নিজেকে শোধন করে নেন; পৃথিবীতে দিনরাত অত্যন্ত আলগোছে আছেন পাছে জ্ঞানে বা অজ্ঞানে কোনো দিক থেকে নিয়মভঙ্গের কণামাত্র ধুলো তাঁকে স্পর্শ করে–ঘোর বাবু যেমন রোদ কাটিয়ে, ধুলো বাঁচিয়ে, নিজের রঙের জেল্লা, চুলের বাহার, কাপড়ের পারিপাট্য রক্ষা করতে সর্বদা ব্যস্ত হয়ে থাকে সেইরকম। গোরা এরকমই নয়। সে হিঁদুয়ানির নিয়মকে অশ্রদ্ধা করে না, কিন্তু সে অমন খুঁটে খুঁটে চলতে পারে না–সে হিন্দুধর্মকে ভিতরের দিক থেকে এবং খুব বড়ো রকম করে দেখে, সে কোনোদিন মনেও করে না যে হিন্দুধর্মের প্রাণ নিতান্ত শৌখিন প্রাণ–অল্প একটু ছোঁয়াছুঁয়িতেই শুকিয়ে যায়, ঠোকাঠেকিতেই মারা পড়ে।”
সুচরিতা। কিন্তু তিনি তো খুব সাবধানে ছোঁয়াছুঁয়ি মেনে চলেন বলেই মনে হয়।
বিনয়। তার ঐ সতর্কতাটা একটা অদ্ভুত জিনিস। তাকে যদি প্রশ্ন করা যায় সে তখনই বলে হাঁ, আমি এ-সমস্তই মানি–ছুঁলে জাত যায়, খেলে পাপ হয়, এ-সমস্তই অভ্রান্ত সত্য। কিন্তু আমি নিশ্চয় জানি, এ কেবল ওর গায়ের জোরের কথা–এ-সব কথা যতই অসংগত হয় ততই ও যেন সকলকে শুনিয়ে উচ্চস্বরে বলে। পাছে বর্তমান হিন্দুয়ানির সামান্য কথাটাকেও অস্বীকার করলে অন্য মূঢ় লোকের কাছে হিন্দুয়ানির বড়ো জিনিসেরও অসম্মান ঘটে এবং যারা হিন্দুয়ানিকে অশ্রদ্ধা করে তারা সেটাকে নিজের জিত বলে গণ্য করে, এইজন্যে গোরা নির্বিচারে সমস্তই মেনে চলতে চায়–আমার কাছেও এ সম্বন্ধে কোনো শৈথিল্য প্রকাশ করতে চায় না।
পরেশবাবু কহিলেন, “ব্রাহ্মদের মধ্যেও এরকম লোক অনেক আছে। তারা হিন্দুয়ানির সমস্ত সংস্রবই নির্বিচারে পরিহার করতে চায়, পাছে বাইরের কোনো লোক ভুল করে যে তারা হিন্দুধর্মের কুপ্রথাকেও স্বীকার করে। এ-সকল লোক পৃথিবীতে বেশ সহজভাবে চলতে পারে না–এরা হয় ভান করে, নয় বাড়াবাড়ি করে; মনে করে সত্য দুর্বল, এবং সত্যকে কেবল কৌশল করে কিম্বা জোর করে রক্ষা করা যেন কর্তব্যের অঙ্গ। “আমার উপরে সত্য নির্ভর করছে, সত্যের উপরে আমি নির্ভর করছি নে’ এইরকম যাদের ধারণা তাদেরই বলে গোঁড়া। সত্যের জোরকে যারা বিশ্বাস করে নিজেদের জবরদস্তিকে তারা সংযত রাখে। বাইরের লোকে দু-দিন দশ-দিন ভুল বুঝলে সামান্যই ক্ষতি, কিন্তু কোনো ক্ষুদ্র সংকোচে সত্যকে স্বীকার না করতে পারলে তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি। আমি ঈশ্বরের কাছে সর্বদাই এই প্রার্থনা করি যে, ব্রাহ্মের সভাতেই হোক আর হিন্দুর চণ্ডীমণ্ডপেই হোক আমি যেন সত্যকে সর্বত্রই নতশিরে অতি সহজেই বিনা বিদ্রোহে প্রণাম করতে পারি– বাইরের কোনো বাধা আমাকে যেন আটক করে না রাখতে পারে।”