গোরা

এই বলিয়া পরেশবাবু স্তব্ধ হইয়া আপনার মনকে যেন আপনার অন্তরে ক্ষণকালের জন্য সমাধান করিলেন। পরেশবাবু মৃদুস্বরে এই-যে কয়টি কথা বলিলেন তাহা এতক্ষণের সমস্ত আলোচনার উপরে যেন একটা বড়ো সুর আনিয়া দিল–সে সুর যে ঐ কয়টি কথার সুর তাহা নহে, তাহা পরেশবাবুর নিজের জীবনের একটি প্রশান্ত গভীরতার সুর। সুচরিতার এবং ললিতার মুখে একটি আনন্দিত ভক্তির দীপ্তি আলো ফেলিয়া গেল। বিনয় চুপ করিয়া রহিল। সেও মনে মনে জানিত গোরার মধ্যে একটা প্রচণ্ড জবরদস্তি আছে–সত্যের বাহকদের বাক্যে মনে ও কর্মে যে একটি সহজ ও সরল শান্তি থাকা উচিত তাহা গোরার নাই–পরেশবাবুর কথা শুনিয়া সে কথা তাহার মনে যেন আরো স্পষ্ট করিয়া আঘাত করিল। অবশ্য, বিনয় এতদিন গোরার পক্ষে এই বলিয়া মনে মনে তর্ক করিয়াছে যে, সমাজের অবস্থা যখন টলমল, বাহিরের দেশকালের সঙ্গে যখন বিরোধ বাধিয়াছে, তখন সত্যের সৈনিকরা স্বাভাবিকতা রক্ষা করিতে পারে না– তখন সাময়িক প্রয়োজনের আকর্ষণে সত্যের মধ্যেও ভাঙচুর আসিয়া পড়ে। আজ পরেশবাবুর কথায় বিনয় ক্ষণকালের জন্য মনে প্রশ্ন করিল যে, সাময়িক প্রয়োজন-সাধনের লুব্ধতায় সত্যকে ক্ষুব্ধ করিয়া তোলা সাধারণ লোকের পক্ষেই স্বাভাবিক, কিন্তু তাহার গোরা কি সেই সাধারণ লোকের দলে?

সুচরিতা রাত্রে বিছানায় আসিয়া শুইলে পর ললিতা তাহার খাটের এক ধারে আসিয়া বসিল। সুচরিতা বুঝিল, ললিতার মনের ভিতর একটা কোনো কথা ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। কথাটা যে বিনয়ের সম্বন্ধে তাহাও সুচরিতা বঝিয়াছিল।

সেইজন্য সুচরিতা আপনি কথা পাড়িল, “বিনয়বাবুকে কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে।”

ললিতা কহিল, “তিনি কিনা কেবলই গৌরবাবুর কথাই বলেন, সেইজন্য তোমার ভালো লাগে।”

সুচরিতা এ কথাটার ভিতরকার ইঙ্গিতটা বুঝিয়াও বুঝিল না। সে একটা সরল ভাব ধারণ করিয়া কহিল, “তা সত্য, ওঁর মুখ থেকে গৌরবাবুর কথা শুনতে আমার ভারি আনন্দ হয়। আমি যেন তাঁকে স্পষ্ট দেখতে পাই।”

ললিতা কহিল, “আমার তো কিছু ভালো লাগে না–আমার রাগ ধরে।”

সুচরিতা আশ্চর্য হইয়া কহিল, “কেন?”

ললিতা কহিল, “গোরা, গোরা, গোরা, দিনরাত্রি কেবল গোরা! ওঁর বন্ধু গোরা হয়তো খুব মস্ত লোক, বেশ তো, ভালোই তো–কিন্তু উনিও তো মানুষ।”

সুচরিতা হাসিয়া কহিল, “তা তো বটেই, কিন্তু তার ব্যাঘাত কি হয়েছে?”

ললিতা। ওঁর বন্ধু ওঁকে এমনি ঢেকে ফেলেছেন যে উনি নিজেকে প্রকাশ করতে পারছেন না। যেন কাঁচপোকায় তেলাপোকাকে ধরেছে–ওরকম অবস্থায় কাঁচপোকার উপরেও আমার রাগ ধরে, তেলাপোকার উপরেও আমার শ্রদ্ধা হয় না।

ললিতার কথার ঝাঁজ দেখিয়া সুচরিতা কিছু না বলিয়া হাসিতে লাগিল।

ললিতা কহিল, “দিদি, তুমি হাসছ, কিন্ত আমি তোমাকে বলছি, আমাকে যদি কেউ ওরকম করে চাপা দিতে চেষ্টা করত আমি তাকে একদিনের জন্যেও সহ্য করতে পারতুম না। এই মনে করো, তুমি–লোকে যাই মনে করুক তুমি আমাকে আচ্ছন্ন করে রাখ নি–তোমার সেরকম প্রকৃতিই নয়–সেইজন্যেই আমি তোমাকে এতো ভালোবাসি। আসল, বাবার কাছে থেকে তোমার ঐ শিক্ষা হয়েছে–তিনি সব লোককেই তার জায়গাটুকু ছেড়ে দেন।”

এই পরিবারের মধ্যে সুচরিতা এবং ললিতা পরেশবাবুর পরম ভক্ত–বাবা বলিতেই তাহাদের হৃদয় যেন স্ফীত হইয়া উঠে।

সুচরিতা কহিল, “বাবার সঙ্গে কি আর কারো তুলনা হয়? কিন্তু যাই বল ভাই, বিনয়বাবু ভারি চমৎকার করে বলতে পারেন।”

ললিতা। ওগুলো ঠিক ওঁর মনের কথা নয় বলেই অত চমৎকার করে বলেন। যদি নিজের কথা বলতেন তা হলে বেশ দিব্যি সহজ কথা হত; মনে হত না যে ভেবে ভেবে বানিয়ে বানিয়ে বলছেন। চমৎকার কথার চেয়ে সে আমার ঢের ভালো লাগে।

সুচরিতা। তা, রাগ করিস কেন ভাই? গৌরমোহনবাবুর কথাগুলো ওঁর নিজেরই কথা হয়ে গেছে।

ললিতা। তা যদি হয় তো সে ভারি বিশ্রী–ঈশ্বর কি বুদ্ধি দিয়েছেন পরের কথা ব্যাখ্যা করবার আর মুখ দিয়েছেন পরের কথা চমৎকার করে বলবার জন্যে? অমন চমৎকার কথায় কাজ নেই।

সুরচিতা। কিন্তু এটা তুই বুঝছিস নে কেন যে বিনয়বাবু গৌরমোহনবাবুকে ভালোবাসেন–তাঁর সঙ্গে ওঁর মনের সত্যিকার মিল আছে।

ললিতা অসহিষ্ণু হইয়া বলিয়া উঠিল, “না, না, না, সম্পূর্ণ মিল নেই। গৌরমোহনবাবুকে মেনে চলা ওঁর অভ্যাস হয়ে গেছে–সেটা দাসত্ব, সে ভালোবাসা নয়। অথচ উনি জোর করে মনে করতে চান যে তাঁর সঙ্গে ওঁর ঠিক এক মত, সেইজন্যেই তাঁর মতগুলিকে উনি অত চেষ্টা করে চমৎকার করে বলে নিজেকে ও অন্যকে ভোলাতে ইচ্ছা করেন। উনি কেবলই নিজের মনের সন্দেহকে বিরোধকে চাপা দিয়ে চলতে চান, পাছে গৌরমোহনবাবুকে না মানতে হয়। তাঁকে না মানবার সাহস ওঁর নেই। ভালোবাসা থাকলে মতের সঙ্গে না মিললেও মানা যেতে পারে–অন্ধ না হয়েও নিজেকে ছেড়ে দেওয়া যায়–ওঁর তো তা নয়–উনি গৌরমোহনবাবুকে মানছেন হয়তো ভালোবাসা থেকে, অথচ কিছুতে সেটা স্বীকার করতে পারছেন না। ওঁর কথা শুনলেই সেটা বেশ স্পষ্ট বোঝা যায়। আচ্ছা দিদি, তুমি বোঝ নি? সত্যি বলো।”

সুচরিতা ললিতার মতো এ কথা এমন করিয়া ভাবেই নাই। কারণ, গোরাকে সম্পূর্ণরূপে জানিবার জন্যই তাহার কৌতূহল ব্যগ্র হইয়াছিল–বিনয়কে স্বতন্ত্র করিয়া দেখিবার জন্য তাহার আগ্রহই ছিল না। সুচরিতা ললিতার প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “আচ্ছা, বেশ, তোর কথাই মেনে নেওয়া গেল–তা কী করতে হবে বল্‌।”

0 Shares