গোরা

গোরা এই কথায় সুচরিতার মুখে একটুখানি বিস্ময়ের আভাস দেখিয়া কহিল, “আপনি মনে করবেন না গবর্মেন্টের উপর রাগ করে আমি এমন কথা বলছি। গবর্মেন্টের কাজ যারা করে তারা গবর্মেন্টের শক্তিকে নিজের শক্তি বলে একটা গর্ব বোধ করে এবং দেশের লোকের থেকে একটা ভিন্ন শ্রেণীর হয়ে ওঠে– যত দিন যাচ্ছে আমাদের এই ভাবটা ততই বেড়ে উঠছে। আমি জানি আমার একটি আত্মীয় সাবেক কালের ডেপুটি ছিলেন– এখন তিনি কাজ ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। তাঁকে ডিস্ট্রিক্ট্‌ ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসা করেছিলেন– বাবু, তোমার বিচারে এত বেশি লোক খালাস পায় কেন? তিনি জবাব দিয়েছিলেন– সাহেব, তার একটি কারণ আছে; তুমি যাদের জেলে দাও তারা তোমার পক্ষে কুকুর-বিড়াল মাত্র, আর আমি যাদের জেলে দিই তারা যে আমার ভাই হয়। এত বড়ো কথা বলতে পারে এমন ডেপুটি তখনো ছিল এবং শুনতে পারে এমন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটেরও অভাব ছিল না। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে চাকরির দড়াদড়ি অঙ্গের ভূষণ হয়ে উঠছে এবং এখনকার ডেপুটির কাছে তাঁর দেশের লোক ক্রমেই কুকুর-বিড়াল হয়ে দাঁড়াচ্ছে, এবং এমনি করে পদের উন্নতি হতে হতে তাঁদের যে কেবলই অধোগতি হচ্ছে এ কথার অনুভূতি পর্যন্ত তাঁদের চলে যাচ্ছে। পরের কাঁধে ভর দিয়ে নিজের লোকদের নিচু করে দেখব এবং নিচু করে দেখবামাত্রই তাদের প্রতি অবিচার করতে বাধ্য হব, এতে কোনো মঙ্গল হতে পারে না।”

বলিয়া গোরা টেবিলে একটা মুষ্টি আঘাত করিল; তেলের শেজটা কাঁপিয়া উঠিল। বিনয় কহিল, “গোরা, এ টেবিলটা গবর্মেন্টের নয়, আর এই শেজটা পরেশবাবুদের।”

শুনিয়া গোরা উচ্চৈঃস্বরে হাসিয়া উঠিল। তাহার হাস্যের প্রবল ধ্বনিতে সমস্ত বাড়িটা পরিপূর্ণ হইয়া গেল। ঠাট্টা শুনিয়া গোরা যে ছেলেমানুষের মতো এমন প্রচুরভাবে হাসিয়া উঠিতে পারে ইহাতে সুচরিতা আশ্চর্য বোধ করিল এবং তাহার মনের মধ্যে ভারি একটা আনন্দ হইল। যাহারা বড়ো কথার চিন্তা করে তাহারা যে প্রাণ খুলিয়া হাসিতে পারে এ কথা তাহার জানা ছিল না।

গোরা সেদিন অনেক কথাই বলিল। সুচরিতা যদিও চুপ করিয়া ছিল কিন্তু তাহার মুখের ভাবে গোরা এমন একটা সায় পাইল যে, উৎসাহে তাহার হৃদয় ভরিয়া উঠিল। শেষকালে সুচরিতাকেই যেন বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া কহিল, “দেখুন, একটি কথা মনে রাখবেন– যদি এমন ভুল সংস্কার আমাদের হয় যে, ইংরেজরা যখন প্রবল হয়ে উঠেছে তখন আমরাও ঠিক ইংরেজটি না হলে কোনোমতে প্রবল হতে পারব না, তা হলে সে অসম্ভব কোনোদিন সম্ভব হবে না এবং কেবলই নকল করতে করতে আমরা দুয়ের বার হয়ে যাব। এ কথা নিশ্চয় জানবেন ভারতের একটা বিশেষ প্রকৃতি, বিশেষ শক্তি, বিশেষ সত্য আছে, সেইটের পরিপূর্ণ বিকাশের দ্বারাই ভারত সার্থক হবে, ভারত রক্ষা পাবে। ইংরেজের ইতিহাস পড়ে এইটে যদি আমরা না শিখে থাকি তবে সমস্তই ভুল শিখেছি। আপনার প্রতি আমার এই অনুরোধ, আপনি ভারতবর্ষের ভিতরে আসুন, এর সমস্ত ভালোমন্দের মাঝখানেই নেবে দাঁড়ান,– যদি বিকৃতি থাকে, তবে ভিতর থেকে সংশোধন করে তুলুন, কিন্তু একে দেখুন, বুঝুন, ভাবুন, এর দিকে মুখ ফেরান, এর সঙ্গে এক হোন– এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, বাইরে থেকে খৃস্টানি সংস্কারে বাল্যকাল হতে অস্থিমজ্জায় দীক্ষিত হয়ে, একে আপনি বুঝতেই পারবেন না, একে কেবলই আঘাত করতেই থাকবেন, এর কোনো কাজেই লাগবেন না।”

গোরা বলিল বটে “আমার অনুরোধ’; কিন্তু এ তো অনুরোধ নয়, এ যেন আদেশ। কথার মধ্যে এমন একটা প্রচণ্ড জোর যে, তাহা অন্যের সম্মতির অপেক্ষাই করে না। সুচরিতা মুখ নত করিয়াই সমস্ত শুনিল। এমন একটা প্রবল আগ্রহের সঙ্গে গোরা যে তাহাকেই বিশেষভাবে সম্বোধন করিয়া এই কথা কয়টি কহিল তাহাতে সুচরিতার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত করিয়া দিল। সে আন্দোলন যে কিসের তখন তাহা ভাবিবার সময় ছিল না। ভারতবর্ষ বলিয়া যে একটা বৃহৎ প্রাচীন সত্তা আছে সুচরিতা সে কথা কোনোদিন এক মুহূর্তের জন্যও ভাবে নাই। এই সত্তা যে দূর অতীত ও সুদূর ভবিষ্যৎকে অধিকারপূর্বক নিভৃতে থাকিয়া মানবের বিরাট ভাগ্যজালে একটা বিশেষ রঙের সুতা একটা বিশেষ ভাবে বুনিয়া চলিয়াছে; সেই সুতা যে কত সূক্ষ্ণ, কত বিচিত্র এবং কত সুদূর সার্থকতার সহিত তাহার কত নিগূঢ় সম্বন্ধ– সুচরিতা আজ তাহা গোরার প্রবল কণ্ঠের কথা শুনিয়া যেন হঠাৎ একরকম করিয়া উপলব্ধি করিল। প্রত্যেক ভারতবাসীর জীবন যে এত বড়ো একটা সত্তার দ্বারা বেষ্টিত, অধিকৃত, তাহা সচেতনভাবে অনুভব না করিলে আমরা যে কতই ছোটো হইয়া এবং চারি দিক সম্বন্ধে কতই অন্ধ হইয়া কাজ করিয়া যাই নিমেষের মধ্যেই তাহা যেন সুচরিতার কাছে প্রকাশ পাইল। সেই অকস্মাৎ চিত্ত-স্ফূর্তির আবেগে সুচরিতা তাহার সমস্ত সংকোচ দূর করিয়া দিয়া অত্যন্ত সহজ বিনয়ের সহিত কহিল, “আমি দেশের কথা কখনো এমন করে, বড়ো করে, সত্য করে ভাবি নি। কিন্তু একটা কথা আমি জিজ্ঞাসা করি– ধর্মের সঙ্গে দেশের যোগ কী? ধর্ম কি দেশের অতীত নয়?”

গোরার কানে সুচরিতার মৃদু কণ্ঠের এই প্রশ্ন বড়ো মধুর লাগিল। সুচরিতার বড়ো বড়ো দুইটি চোখের মধ্যে এই প্রশ্নটি আরো মধুর করিয়া দেখা দিল। গোরা কহিল, “দেশের অতীত যা, দেশের চেয়ে যা অনেক বড়ো, তাই দেশের ভিতর দিয়ে প্রকাশ পায়। ঈশ্বর এমনি করে বিচিত্র ভাবে আপনার অনন্ত স্বরূপকেই ব্যক্ত করছেন। যাঁরা বলেন সত্য এক, অতএব কেবলই একটি ধর্মই সত্য, ধর্মের একটিমাত্র রূপই সত্য– তাঁরা, সত্য যে এক কেবল এই সত্যটিই মানেন, আর সত্য যে অন্তহীন সে সত্যটা মানতে চান না। অন্তহীন-এক অন্তহীন অনেকে আপনাকে প্রকাশ করেন– জগতে সেই লীলাই তো দেখছি। সেইজন্যেই ধর্মমত বিচিত্র হয়ে সেই ধর্মরাজকে নানা দিক দিয়ে উপলব্ধি করাচ্ছে। আমি আপনাকে নিশ্চয় বলছি, ভারতবর্ষের খোলা জানলা দিয়ে আপনি সূর্যকে দেখতে পাবেন– সেজন্যে সমুদ্রপারে গিয়ে খৃস্টান গির্জার জানলায় বসবার কোনো দরকার হবে না।”

0 Shares