গোরা

গোরা বিনা কাজে ভ্রমণে বাহির হইয়াছে, কবে ফিরিবে তাহা কেহ জানিত না। যদিও সুচরিতা এ সম্বন্ধে কোনো কথা মনে স্থান দিবে না ভাবিয়াছিল তবু প্রতিদিনই তাহার মনের ভিতরে আশা জন্মিত যে আজ হয়তো গোরা আসিবে। এ আশা কিছুতেই সে মন হইতে দমন করিতে পারিত না। গোরার ঔদাসীন্য এবং নিজের মনের এই অবাধ্যতায় যখন সে নিরতিশয় পীড়া বোধ করিতেছিল, যখন কোনোমতে এই জাল ছিন্ন করিয়া পলায়ন করিবার জন্য তাহার চিত্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিয়াছিল, এমন সময় হারানবাবু একদিন বিশেষভাবে ঈশ্বরের নাম করিয়া সুচরিতার সহিত তাহার সম্বন্ধ পাকা করিবার জন্য পরেশবাবুকে পুনর্বার অনুরোধ করিলেন। পরেশবাবু কহিলেন, “এখন তো বিবাহের বিলম্ব আছে, এত শীঘ্র আবদ্ধ হওয়া কি ভালো?”

হারানবাবু কহিলেন, “বিবাহের পূর্বে কিছুকাল এই আবদ্ধ অবস্থায় যাপন করা উভয়ের মনের পরিণতির পক্ষে বিশেষ আবশ্যক বলে মনে করি। প্রথম পরিচয় এবং বিবাহের মাঝখানে এইরকম একটা আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, যাতে সাংসারিক দায়িত্ব নেই অথচ বন্ধন আছে– এটা বিশেষ উপকারী।”

পরেশবাবু কহিলেন, “আচ্ছা, সুচরিতাকে জিজ্ঞাসা করে দেখি।”

হারানবাবু কহিলেন, “তিনি তো পূর্বেই মত দিয়েছেন।”

হারানবাবুর প্রতি সুচরিতার মনের ভাব সম্বন্ধে পরেশবাবুর এখনো সন্দেহ ছিল, তাই তিনি নিজে সুচরিতাকে ডাকিয়া তাহার নিকট হারানবাবুর প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন। সুচরিতা নিজের দ্বিধাগ্রস্ত জীবনকে একটা কোথাও চূড়ান্তভাবে সমর্পণ করিতে পারিলে বাঁচে– তাই সে এমন অবিলম্বে এবং নিশ্চিতভাবে সম্মতি দিল যে পরেশবাবুর সমস্ত সন্দেহ দূর হইয়া গেল। বিবাহের এত পূর্বে আবদ্ধ হওয়া কর্তব্য কি না তাহা তিনি ভালোরূপ বিবেচনা করিবার জন্য সুচরিতাকে অনুরোধ করিলেন– তৎসত্ত্বেও সুচরিতা এ প্রস্তাবে কিছুমাত্র আপত্তি করিল না।

ব্রাউন্‌লো সাহেবের নিমন্ত্রণ সারিয়া আসিয়া একটি বিশেষ দিনে সকলকে ডাকিয়া ভাবী দম্পতির সম্বন্ধ পাকা করা হইবে এইরূপ স্থির হইল।

সুচরিতার ক্ষণকালের জন্য মনে হইল তাহার মন যেন রাহুর গ্রাস হইতে মুক্ত হইয়াছে। সে মনে মনে স্থির করিল, হারানবাবুকে বিবাহ করিয়া ব্রাহ্মসমাজের কাজে যোগ দিবার জন্য সে মনকে কঠোরভাবে প্রস্তুত করিবে। হারানবাবুর নিকট হইতেই সে প্রত্যহ খানিকটা করিয়া ধর্মতত্ত্ব সম্বন্ধে ইংরেজি বই পড়িয়া তাঁহারই নির্দেশমত চলিতে থাকিবে এইরূপ সংকল্প করিল। তাহার পক্ষে যাহা দুরূহ, এমন-কি অপ্রিয়, তাহাই গ্রহণ করিবার প্রতিজ্ঞা করিয়া সে মনের মধ্যে খুব একটা স্ফীতি অনুভব করিল।

হারানবাবুর সম্পাদিত ইংরেজি কাগজ কিছুকাল ধরিয়া সে পড়ে নাই। আজ সেই কাগজ ছাপা হইবামাত্র তাহা হাতে আসিয়া পড়িল। বোধ করি হারানবাবু বিশেষ করিয়াই পাঠাইয়া দিয়াছেন।

সুচরিতা কাগজখানি ঘরে লইয়া গিয়া স্থির হইয়া বসিয়া পরম কর্তব্যের মতো তাহার প্রথম লাইন হইতে পড়িতে আরম্ভ করিল। শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে নিজেকে ছাত্রীর মতো জ্ঞান করিয়া এই পত্রিকা হইতে উপদেশ গ্রহণ করিতে লাগিল।

জাহাজ পালে চলিতে চলিতে হঠাৎ পাহাড়ে ঠেকিয়া কাত হইয়া পড়িল। এই সংখ্যায় “সেকেলে বায়ুগ্রস্ত’-নামক একটি প্রবন্ধ আছে, তাহাতে বর্তমান কালের মধ্যে বাস করিয়াও যাহারা সেকালের দিকে মুখ ফিরাইয়া আছে তাহাদিগকে আক্রমণ করা হইয়াছে। যুক্তিগুলি যে অসংগত তাহা নহে, বস্তুত এরূপ যুক্তি সুচরিতা সন্ধান করিতেছিল, কিন্তু প্রবন্ধটি পড়িবা মাত্রই সে বুঝিতে পারিল যে এই আক্রমণের লক্ষ্য গোরা। অথচ তাহার নাম নাই, অথবা তাহার লিখিত কোনো প্রবন্ধের উল্লেখ নাই। বন্দুকের প্রত্যেক গুলির দ্বারা একটা করিয়া মানুষ মারিয়া সৈনিক যেমন খুশি হয় এই প্রবন্ধের প্রত্যেক বাক্যে তেমনি কোনো-একটি সজীব পদার্থ বিদ্ধ হইতেছে বলিয়া যেন একটা হিংসার আনন্দ ব্যক্ত হইয়া উঠিয়াছে।

এই প্রবন্ধ সুচরিতার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিল। ইহার প্রত্যেক যুক্তি প্রতিবাদের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিতে তাহার ইচ্ছা হইল। সে মনে মনে কহিল, গৌরমোহনবাবু যদি ইচ্ছা করেন তবে এই প্রবন্ধকে তিনি ধুলায় লুটাইয়া দিতে পারেন। গোরার উজ্জ্বল মুখ তাহার চোখের সামনে জ্যোতির্ময় হইয়া জাগিয়া উঠিল এবং তাহার প্রবল কণ্ঠস্বর সুচরিতার বুকের ভিতর পর্যন্ত ধ্বনিত হইয়া উঠিল। সেই মুখের ও বাক্যের অসামান্যতার কাছে এই প্রবন্ধ ও প্রবন্ধলেখকের ক্ষুদ্রতা এমনই তুচ্ছ হইয়া উঠিল যে সুচরিতা কাগজখানাকে মাটিতে ফেলিয়া দিল।

অনেক কাল পরে সুচরিতা আপনি সেদিন বিনয়ের কাছে আসিয়া বসিল এবং তাহাকে কথায় কথায় বলিল, “আচ্ছা, আপনি যে বলেছিলেন যে-সব কাগজে আপনাদের লেখা বেরিয়েছে আমাকে পড়তে এনে দেবেন, কই দিলেন না?”

বিনয় এ কথা বলিল না যে ইতিমধ্যে সুচরিতার ভাবান্তর দেখিয়া সে আপন প্রতিশ্রুতি পালন করিতে সাহস করে নাই– সে কহিল, “আমি সেগুলো একত্র সংগ্রহ করে রেখেছি, কালই এনে দেব।”

বিনয় পরদিন পুস্তিকা ও কাগজের এক পুঁটুলি আনিয়া সুচরিতাকে দিয়া গেল। সুচরিতা সেগুলি হাতে পাইয়া আর পড়িল না, বাক্সের মধ্যে রাখিয়া দিল। পড়িতে অত্যন্ত ইচ্ছা করিল বলিয়াই পড়িল না। চিত্তকে কোনোমতেই বিক্ষিপ্ত হইতে দিবে না প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজের বিদ্রোহী চিত্তকে পুনর্বার হারানবাবুর শাসনাধীনে সমর্পণ করিয়া আর-একবার সে সান্ত্বনা অনুভব করিল।

0 Shares