গোরা

হারানবাবু ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিয়া ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত তাঁহার আলাপের বিবরণ বিস্তারিত করিয়া বলিলেন। কিন্তু গোরার সহিত সাক্ষাতের কোনো উল্লেখমাত্র করিলেন না।

২৮

কোনোপ্রকার অপরাধ বিচার না করিয়া কেবলমাত্র গ্রামকে শাসন করিবার জন্য সাতচল্লিশ জন আসামিকে হাজতে দেওয়া হইয়াছে।

ম্যাজিস্ট্রেটের সহিত সাক্ষাতের পর গোরা উকিলের সন্ধানে বাহির হইল। কোনো লোকের কাছে খবর পাইল, সাতকড়ি হালদার এখানকার একজন ভালো উকিল। সাতকড়ির বাড়ি যাইতেই সে বলিয়া উঠিল, “বাঃ, গোরা যে! তুমি এখানে!”

গোরা যা মনে করিয়াছিল তাই বটে– সাতকড়ি গোরার সহপাঠী। গোরা কহিল, চর-ঘোষপুরের আসামিদিগকে জামিনে খালাস করিয়া তাহাদের মকদ্দমা চালাইতে হইবে।

সাতকড়ি কহিল, “জামিন হবে কে?”

গোরা কহিল, “আমি হব।”

সাতকড়ি কহিল, “তুমি সাতচল্লিশ জনের জামিন হবে তোমার এমন কী সাধ্য আছে?”

গোরা কহিল, “যদি মোক্তাররা মিলে জামিন হয় তার ফী আমি দেব।”

সাতকড়ি কহিল, “টাকা কম লাগবে না।”

পরদিন ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে জামিন-খালাসের দরখাস্ত হইল। ম্যাজিস্ট্রেট গতকল্যকার সেই মলিনবস্ত্রধারী পাগড়ি-পরা বীরমূর্তির দিকে একবার কটাক্ষ নিক্ষেপ করিলেন এবং দরখাস্ত অগ্রাহ্য করিয়া দিলেন। চৌদ্দ বৎসরের ছেলে হইতে আশি বৎসরের বুড়া পর্যন্ত হাজতে পচিতে লাগিল।

গোরা ইহাদের হইয়া লড়িবার জন্য সাতকড়িকে অনুরোধ করিল। সাতকড়ি কহিল, “সাক্ষী পাবে কোথায়? যারা সাক্ষী হতে পারত তারা সবাই আসামী তার পরে এই সাহেব-মারা মামলার তদন্তের চোটে এ অঞ্চলের লোক অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। ম্যাজিস্ট্রেটের ধারণা হয়েছে ভিতরে ভিতরে ভদ্রলোকের যোগ আছে; হয়তো বা আমাকেও সন্দেহ করে, বলা যায় না। ইংরেজি কাগজগুলোতে ক্রমাগত লিখছে দেশী লোক যদি এরকম স্পর্ধা পায় তা হলে অরক্ষিত অসহায় ইংরেজরা আর মফস্বলে বাস করতেই পারবে না। ইতিমধ্যে দেশের লোক দেশে টিঁকতে পারছে না এমনি হয়েছে। অত্যাচার হচ্ছে জানি, কিন্তু কিছু করবার জো নেই।”

গোরা গর্জিয়া উঠিয়া কহিল, “কেন জো নেই?”

সাতকড়ি হাসিয়া কহিল, “তুমি ইস্কুলে যেমনটি ছিলে এখনো ঠিক তেমনটি আছ দেখছি। জো নেই মানে, আমাদের ঘরে স্ত্রীপুত্র আছে– রোজ উপার্জন না করলে অনেকগুলো লোককে উপবাস করতে হয়। পরের দায় নিজের ঘাড়ে নিয়ে মরতে রাজি হয় এমন লোক সংসারে বেশি নেই– বিশেষত যে দেশে সংসার জিনিসটি বড়ো ছোটোখাটো জিনিস নয়। যাদের উপর দশ জন নির্ভর করে তারা সেই দশ জন ছাড়া অন্য দশ জনের দিকে তাকাবার অবকাশই পায় না।”

গোরা কহিল, “তা হলে এদের জন্যে কিছুই করবে না? হাইকোর্টে মোশন করে যদি–”

সাতকড়ি অধীর হইয়া কহিল, “আরে, ইংরেজ মেরেছে যে– সেটা দেখছ না! প্রত্যেক ইংরেজটিই যে রাজা– একটা ছোটো ইংরেজকে মারলেও যে সেটা একটা ছোটোরকম রাজবিদ্রোহ। যেটাতে কিছু ফল হবে না সেটার জন্যে মিথ্যে চেষ্টা করতে গিয়ে ম্যাজিস্ট্রেটের কোপানলে পড়ব সে আমার দ্বারা হবে না।”

কলিকাতায় গিয়া সেখানকার কোনো উকিলের সাহায্যে কিছু সুবিধা হয় কি না তাহাই দেখিবার জন্য পরদিন সাড়ে দশটার গাড়িতে রওনা হইবার অভিপ্রায়ে গোরা যাত্রা করিয়াছে, এমন সময় বাধা পড়িয়া গেল।

এখানকার মেলা উপলক্ষেই কলিকাতার একদল ছাত্রের সহিত এখানকার স্থানীয় ছাত্রদলের ক্রিকেট-যুদ্ধ স্থির হইয়াছে। হাত পাকাইবার জন্য কলিকাতার ছেলেরা আপন দলের মধ্যেই খেলিতেছিল। ক্রিকেটের গোলা লাগিয়া একটি ছেলের পায়ে গুরুতর আঘাত লাগে। মাঠের ধারে একটা বড়ো পুষ্করিণী ছিল– আহত ছেলেটিকে দুইটি ছাত্র ধরিয়া সেই পুষ্করিণীর তীরে রাখিয়া চাদর ছিঁড়িয়া জলে ভিজাইয়া তাহার পা বাঁধিয়া দিতেছিল, এমন সময় হঠাৎ কোথা হইতে একটা পাহারাওয়ালা আসিয়াই একেবারে একজন ছাত্রের ঘাড়ে হাত দিয়া ধাক্কা মারিয়া তাহাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিল। পুষ্করিণীটি পানীয় জলের জন্য রিজার্ভ করা, ইহার জলে নামা নিষেধ,কলিকাতার ছাত্র তাহা জানিত না, জানিলেও অকস্মাৎ পাহারাওয়ালার কাছে এরূপ অপমান সহ্য করা তাহাদের অভ্যাস ছিল না, গায়েও জোর ছিল, তাই অপমানের যথোচিত প্রতিকার আরম্ভ করিয়া দিল। এই দৃশ্য দেখিয়া চার-পাঁচজন কন্‌স্টেব্‌ল্‌ ছুটিয়া আসিল। ঠিক এমন সময়টিতেই সেখানে গোরা আসিয়া উপস্থিত। ছাত্ররা গোরাকে চিনিত– গোরা তাহাদিগকে লইয়া অনেকদিন ক্রিকেট খেলাইয়াছে। গোরা যখন দেখিল ছাত্রদিগকে মারিতে মারিতে ধরিয়া লইয়া যাইতেছে, সে সহিতে পারিল না, সে কহিল, “খবরদার! মারিস নে!” পাহারাওয়ালার দল তাহাকেও অশ্রাব্য গালি দিতেই গোরা ঘুষি ও লাথি মারিয়া এমন একটা কাণ্ড করিয়া তুলিল যে রাস্তায় লোক জমিয়া গেল। এ দিকে দেখিতে দেখিতে ছাত্রের দল জুটিয়া গেল। গোরার উৎসাহ ও আদেশ পাইয়া তাহারা পুলিসকে আক্রমণ করিতেই পাহারাওয়ালার দল রণে ভঙ্গ দিল। দর্শকরূপে রাস্তার লোকে অত্যন্ত আমোদ অনুভব করিল; কিন্তু বলা বাহুল্য, এই তামাশা গোরার পক্ষে নিতান্ত তামাশা হইল না।

বেলা যখন তিন-চারটে, ডাকবাংলায় বিনয় হারানবাবু এবং মেয়েরা রিহার্সালে প্রবৃত্ত আছে, এমন সময় বিনয়ের পরিচিত দুইজন ছাত্র আসিয়া খবর দিল, গোরাকে এবং কয়জন ছাত্রকে পুলিসে গ্রেফতার করিয়া লইয়া হাজতে রাখিয়াছে, আগামী কাল ম্যাজিস্ট্রেটের নিকটে প্রথম এজলাসেই ইহার বিচার হইবে।

0 Shares