গোরা

গোরা হাজতে! এ কথা শুনিয়া হারানবাবু ছাড়া আর-সকলেই একেবারে চমকিয়া উঠিল। বিনয় তখনই ছুটিয়া প্রথমে তাহাদের সহপাঠী সাতকড়ি হালদারের নিকট গিয়া তাহাকে সমস্ত জানাইল এবং তাহাকে সঙ্গে লইয়া হাজতে গেল।

সাতকড়ি তাহার পক্ষে ওকালতি ও তাহাকে এখনই জামিনে খালাসের চেষ্টা করিবার প্রস্তাব করিল। গোরা বলিল, “না, আমি উকিলও রাখব না, আমাকে জামিনে খালাসেরও চেষ্টা করতে হবে না।”

সে কী কথা! সাতকড়ি বিনয়ের দিকে ফিরিয়া কহিল, “দেখেছ! কে বলবে গোরা ইস্কুল থেকে বেরিয়েছে! ওর বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক সেইরকমই আছে!”

গোরা কহিল, “দৈবাৎ আমার টাকা আছে, বন্ধু আছে বলেই হাজত আর হাতকড়ি থেকে আমি খালাস পাব সে আমি চাই নে। আমাদের দেশের যে ধর্মনীতি তাতে আমরা জানি সুবিচার করার গরজ রাজার; প্রজার প্রতি অবিচার রাজারই অধর্ম। কিন্তু এ রাজ্যে উকিলের কড়ি না জোগাতে পেরে প্রজা যদি হাজতে পচে, জেলে মরে, রাজা মাথার উপরে থাকতে ন্যায়বিচার পয়সা দিয়ে কিনতে যদি সর্বস্বান্ত হতে হয়, তবে এমন বিচারের জন্যে আমি সিকি-পয়সা খরচ করতে চাই নে।”

সাতকড়ি কহিল, “কাজির আমলে যে ঘুষ দিতেই মাথা বিকিয়ে যেত।”

গোরা কহিল, “ঘুষ দেওয়া তো রাজার বিধান ছিল না। সে কাজি মন্দ ছিল সে ঘুষ নিত, এ আমলেও সেটা আছে। কিন্তু এখন রাজদ্বারে বিচারের জন্যে দাঁড়াতে গেলেই, বাদী হোক প্রতিবাদী হোক, দোষী হোক, নির্দোষ হোক, প্রজাকে চোখের জল ফেলতেই হবে। যে পক্ষ নির্ধন, বিচারের লড়াইয়ে জিত-হার দুই তার পক্ষে সর্বনাশ। তার পরে রাজা যখন বাদী আর আমার মতো লোক প্রতিবাদী, তখন তাঁর পক্ষেই উকিল ব্যারিস্টার– আর আমি যদি জোটাতে পারলুম তো ভালো, নইলে অদৃষ্টে যা থাকে! বিচারে যদি উকিলের সাহায্যের প্রয়োজন না থাকে তবে সরকারি উকিল আছে কেন? যদি প্রয়োজন থাকে তো গবর্মেন্টের বিরুদ্ধপক্ষ কেন নিজের উকিল নিজে জোটাতে বাধ্য হবে? এ কি প্রজার সঙ্গে শত্রুতা? এ কী রকমের রাজধর্ম?”

সাতকড়ি কহিল, “ভাই, চট কেন? সিভিলিজেশন সস্তা জিনিস নয়। সূক্ষ্ণ বিচার করতে গেলে সূক্ষ্ণ আইন করতে হয়, সূক্ষ্ণ আইন করতে গেলেই আইনের ব্যবসায়ী না হলে কাজ চলেই না, ব্যাবসা চালাতে গেলেই কেনাবেচা এসে পড়ে– অতএব সভ্যতার আদালত আপনিই বিচার-কেনাবেচার হাট হয়ে উঠবেই– যার টাকা নেই তার ঠকবার সম্ভাবনা থাকবেই। তুমি রাজা হলে কী করতে বলো দেখি।”

গোরা কহিল, “যদি এমন আইন করতুম যে হাজার দেড় হাজার টাকা বেতনের বিচারকের বুদ্ধিতেও তার রহস্য ভেদ হওয়া সম্ভব হত না, তা হলে হতভাগা বাদী প্রতিবাদী উভয় পক্ষের জন্য উকিল সরকারি খরচে নিযুক্ত করে দিতুম। বিচার ভালো হওয়ার খরচা প্রজার ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে সুবিচারের গৌরব করে পাঠান-মোগলদের গাল দিতুম না।”

সাতকড়ি কহিল, “বেশ কথা, সে শুভদিন যখন আসে নি– তুমি যখন রাজা হও নি– সম্প্রতি তুমি যখন সভ্য রাজার আদালতের আসামী– তখন তোমাকে হয় গাঁটের কড়ি খরচ করতে হবে নয় উকিল-বন্ধুর শরণাপন্ন হতে হবে, নয় তো তৃতীয় গতিটা সদ্‌গতি হবে না।”

গোরা জেদ করিয়া কহিল, “কোনো চেষ্টা না করে যে গতি হতে পারে আমার সেই গতিই হোক। এ রাজ্যে সম্পূর্ণ নিরুপায়ের যে গতি, আমারও সেই গতি।”

বিনয় অনেক অনুনয় করিল, কিন্তু গোরা তাহাতে কর্ণপাতমাত্র করিল না। সে বিনয়কে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি হঠাৎ এখানে কী করে উপস্থিত হলে।?”

বিনয়ের মুখ ঈষৎ রক্তাভ হইয়া উঠিল। গোরা যদি আজ হাজতে না থাকিত তবে বিনয় হয়তো কিছু বিদ্রোহের স্বরেই তাহার এখানে উপস্থিতির কারণটা বলিয়া দিত। আজ স্পষ্ট উত্তরটা তাহার মুখে বাধিয়া গেল; কহিল, “আমার কথা পরে হবে– এখন তোমার–”

গোরা কহিল, “আমি তো আজ রাজার অতিথি। আমার জন্যে রাজা স্বয়ং ভাবছেন, তোমাদের আর কারো ভাবতে হবে না।”

বিনয় জানিত গোরাকে টলানো সম্ভব নয়– অতএব উকিল রাখার চেষ্টা ছাড়িয়া দিতে হইল। বলিল, “তুমি তো খেতে এখানে পারবে না জানি, বাইরে থেকে কিছু খাবার পাঠাবার জোগাড় করে দিই।”

গোরা অধীর হইয়া কহিল, “বিনয়, কেন তুমি বৃথা চেষ্টা করছ। বাইরে থেকে আমি কিছুই চাই নে। হাজতে সকলের ভাগ্যে যা জোটে আমি তার চেয়ে কিছু বেশি চাই নে।”

বিনয় ব্যথিত চিত্তে ডাকবাংলায় ফিরিয়া আসিল। সুচরিতা রাস্তার দিকের একটা শোবার ঘরে দরজা বন্ধ করিয়া জানালা খুলিয়া বিনয়ের প্রত্যাবর্তন প্রতীক্ষা করিয়া ছিল। কোনোমতেই অন্য সকলের সঙ্গ এবং আলাপ সে সহ্য করিতে পারিতেছিল না।

সুচরিতা যখন দেখিল বিনয় চিন্তিত বিমর্ষমুখে ডাকবাংলার অভিমুখে আসিতেছে তখন আশঙ্কায় তাহার বুকের মধ্যে তোলাপাড়া করিতে লাগিল। বহু চেষ্টায় সে নিজেকে শান্ত করিয়া একটা বই হাতে করিয়া বসিবার ঘরে আসিল। ললিতা সেলাই ভালোবাসে না, কিন্তু সে আজ চুপ করিয়া কোণে বসিয়া সেলাই করিতেছিল– লাবণ্য সুধীরকে লইয়া ইংরেজি বানানের খেলা খেলিতেছিল, লীলা ছিল দর্শক; হারানবাবু বরদাসুন্দরীর সঙ্গে আগামী কল্যকার উৎসবের কথা আলোচনা করিতেছিলেন।

আজ প্রাতঃকালে পুলিসের সঙ্গে গোরার বিরোধের ইতিহাস বিনয় সমস্ত বিবৃত করিয়া বলিল। সুচরিতা স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল, ললিতার কোল হইতে সেলাই পড়িয়া গেল এবং মুখ লাল হইয়া উঠিল।

0 Shares