গোরা

বিনয় বিস্মিত হইয়া কহিল, “জাহাজ যে ছেড়ে দিচ্ছে।”

ললিতা কহিল, “সে আমি জানি।”

বলিয়া বিনয়ের জন্য অপেক্ষা না করিয়াই সম্মুখের সিঁড়ি বাহিয়া উপরের তলায় উঠিয়া গেল। স্টীমার বাঁশি ফুঁকিতে ফুঁকিতে ছাড়িয়া দিল।

বিনয় ললিতাকে ফাস্ট্‌ ক্লাসের ডেকে কেদারায় বসাইয়া নীরব প্রশ্নে তাহার মুখের দিকে চাহিল।

ললিতা কহিল, “আমি কলকাতায় যাব– আমি কিছুতেই থাকতে পারলুম না।”

বিনয় জিজ্ঞাসা করিল, “ওঁরা সকলে?”

ললিতা কহিল, “এখন পর্যন্ত কেউ জানেন না। আমি চিঠি রেখে এসেছি– পড়লেই জানতে পারবেন।”

ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয় স্তম্ভিত হইয়া গেল। সংকোচের সহিত বলিতে আরম্ভ করিল, “কিন্তু–”

ললিতা তাড়াতাড়ি বাধা দিয়া কহিল, “জাহাজ ছেড়ে দিয়েছে, এখন আর “কিন্তু’ নিয়ে কী হবে! মেয়েমানুষ হয়ে জন্মেছি বলেই যে সমস্তই চুপ করে সহ্য করতে হবে সে আমি বুঝি নে। আমাদের পক্ষেও ন্যায়-অন্যায় সম্ভব-অসম্ভব আছে। আজকের নিমন্ত্রণে গিয়ে অভিনয় করার চেয়ে আত্মহত্যা করা আমার পক্ষে সহজ।”

বিনয় বুঝিল যা হইবার তা হইয়া গেছে, এখন এ কাজের ভালোমন্দ বিচার করিয়া মনকে পীড়িত করিয়া তোলায় কোনো ফল নাই।

কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ললিতা কহিল, “দেখুন, আপনার বন্ধু গৌরমোহনবাবুর প্রতি আমি মনে মনে বড়ো অবিচার করেছিলুম। জানি নে, প্রথম থেকেই কেন তাঁকে দেখে, তাঁর কথা শুনে, আমার মনটা তাঁর বিরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি বড়ো বেশি জোর দিয়ে কথা কইতেন, আর আপনারা সকলেই তাতে যেন সায় দিয়ে যেতেন– তাই দেখে আমার একটা রাগ হতে থাকত। আমার স্বভাবই ঐ– আমি যদি দেখি কেউ কথায় বা ব্যবহারে জোর প্রকাশ করছে, সে আমি একেবারেই সইতে পারি নে। কিন্তু গৌরমোহনবাবুর জোর কেবল পরের উপরে নয়, সে তিনি নিজের উপরেও খাটান– এ সত্যিকার জোর– এরকম মানুষ আমি দেখি নি।”

এমনি করিয়া ললিতা বকিয়া যাইতে লাগিল। কেবল যে গোরা সম্বন্ধে সে অনুতাপ বোধ করিতেছিল বলিয়াই এ-সকল কথা বলিতেছিল তাহা নহে। আসলে, ঝোঁকের মাথায় যে কাজটা করিয়া ফেলিয়াছে তাহার সংকোচ মনের ভিতর হইতে কেবলই মাথা তুলিবার উপক্রম করিতেছিল, কাজটা হয়তো ভালো হয় নাই এই দ্বিধা জোর করিবার লক্ষণ দেখা যাইতেছিল, বিনয়ের সম্মুখে স্টীমারে এইরূপ একলা বসিয়া থাকা যে এতবড়ো কুণ্ঠার বিষয় তাহা সে পূর্বে মনেও করিতে পারে নাই, কিন্তু লজ্জা প্রকাশ হইলেই জিনিসটা অত্যন্ত লজ্জার বিষয় হইয়া উঠিবে এইজন্য সে প্রাণপণে বকিয়া যাইতে লাগিল। বিনয়ের মুখে ভালো করিয়া কথা জোগাইতেছিল না। এক দিকে গোরার দুঃখ ও অপমান, অন্য দিকে সে যে এখানে ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ি আমোদ করিতে আসিয়াছিল তাহার লজ্জা, তাহার উপরে ললিতার সম্বন্ধে তাহার এই অকস্মাৎ অবস্থাসংকট, সমস্ত একত্র মিশ্রিত হইয়া বিনয়কে বাক্যহীন করিয়া দিয়াছিল।

পূর্বে হইলে ললিতার এই দুঃসাহসিকতায় বিনয়ের মনে তিরস্কারের ভাব উদয় হইত– আজ তাহা কোনোমতেই হইল না। এমন-কি, তাহার মনে যে বিস্ময়ের উদয় হইয়াছিল তাহার সঙ্গে শ্রদ্ধা মিশ্রিত ছিল– ইহাতে আরো একটি আনন্দ এই ছিল, তাহাদের সমস্ত দলের মধ্যে গোরার অপমানের সামান্য প্রতিকারচেষ্টা কেবল বিনয় এবং ললিতাই করিয়াছে। এজন্য বিনয়কে বিশেষ কিছু দুঃখ পাইতে হইবে না, কিন্তু ললিতাকে নিজের কর্মফলে অনেক দিন ধরিয়া বিস্তর পীড়া ভোগ করিতে হইবে। অথচ এই ললিতাকে বিনয় বরাবর গোরার বিরুদ্ধ বলিয়াই জানিত। যতই ভাবিতে লাগিল ততই ললিতার এই পরিণামবিচারহীন সাহসে এবং অন্যায়ের প্রতি একান্ত ঘৃণায় তাহার প্রতি বিনয়ের ভক্তি জন্মিতে লাগিল। কেমন করিয়া কী বলিয়া যে সে এই ভক্তি প্রকাশ করিবে তাহা ভাবিয়া পাইল না। বিনয় বার বার ভাবিতে লাগিল, ললিতা যে তাহাকে এত পরমুখাপেক্ষী সাহসহীন বলিয়া ঘৃণা প্রকাশ করিয়াছে সে ঘৃণা যথার্থ। সে তো সমস্ত আত্মীয়বন্ধুর নিন্দা প্রশংসা সবলে উপেক্ষা করিয়া এমন করিয়া কোনো বিষয়েই সাহসিক আচরণের দ্বারা নিজের মত প্রকাশ করিতে পারিত না। সে যে অনেক সময়েই গোরাকে কষ্ট দিবার ভয়ে অথবা পাছে গোরা তাহাকে দুর্বল মনে করে এই আশঙ্কায় নিজের স্বভাবের অনুসরণ করে নাই, অনেক সময় সূক্ষ্ণ যুক্তিজাল বিস্তার করিয়া গোরার মতকে নিজের মত বলিয়াই নিজেকে ভুলাইবার চেষ্টা করিয়াছে, আজ তাহা মনে মনে স্বীকার করিয়া ললিতাকে স্বাধীনবুদ্ধিশক্তিগুণে নিজের চেয়ে অনেক শ্রেষ্ঠ বলিয়া মানিল। ললিতাকে সে যে পূর্বে অনেকবার মনে মনে নিন্দা করিয়াছে, সে কথা স্মরণ করিয়া তাহার লজ্জা বোধ হইল। এমন-কি, ললিতার কাছে তাহার ক্ষমা চাহিতে ইচ্ছা করিল– কিন্তু কেমন করিয়া ক্ষমা চাহিবে ভাবিয়া পাইল না। ললিতার কমনীয় স্ত্রীমূর্তি আপন অন্তরের তেজে বিনয়ের চক্ষে আজ এমন একটি মহিমায় উদ্দীপ্ত হইয়া দেখা দিল যে, নারীর এই অপূর্ব পরিচয়ে বিনয় নিজের জীবনকে সার্থক বোধ করিল। সে নিজের সমস্ত অহংকার, সমস্ত ক্ষুদ্রতাকে এই মাধুর্যমণ্ডিত শক্তির কাছে আজ একেবারে বিসর্জন দিল।

৩০

ললিতাকে সঙ্গে লইয়া বিনয় পরেশবাবুর বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

ললিতার সম্বন্ধে বিনয়ের মনের ভাবটা কী তাহা স্টীমারে উঠিবার পূর্বে পর্যন্ত বিনয় নিশ্চিত জানিত না। ললিতার সঙ্গে বিরোধেই তাহার মন ব্যাপৃত ছিল। কেমন করিয়া এই দুর্বশ মেয়েটির সঙ্গে কোনোমতে সন্ধিস্থাপন হইতে পারে কিছুকাল হইতে ইহাই তাহার প্রায় প্রতিদিনের চিন্তার বিষয় ছিল। বিনয়ের জীবনে স্ত্রীমাধুর্যের নির্মল দীপ্তি লইয়া সুচরিতাই প্রথম সন্ধ্যাতারাটির মতো উদিত হইয়াছিল। এই আবির্ভাবের অপরূপ আনন্দে বিনয়ের প্রকৃতিকে পরিপূর্ণতা দান করিয়া আছে, ইহাই বিনয় মনে মনে জানিত। কিন্তু ইতিমধ্যে আরো যে তারা উঠিয়াছে এবং জ্যোতিরূৎসবের ভূমিকা করিয়া দিয়া প্রথম তারাটি যে কখন্‌ ধীরে ধীরে দিগন্তরালে অবতরণ করিতেছিল বিনয় তাহা স্পষ্ট করিয়া বুঝিতে পারে নাই।

0 Shares