গোরা

রাত্রে আনন্দময়ী অনেকক্ষণ এই কথা লইয়া মনে মনে আলোচনা করিয়াছিলেন। গোরার জীবনের যে সমস্যা উত্তরোত্তর জটিল হইয়া উঠিতেছিল পরেশবাবুর ঘরেই তাহার একটা মীমাংসা ঘটিতে পারে এই কথা মনে করিয়া তিনি ভাবিতে লাগিলেন, যেমন করিয়া হউক, মেয়েদের সঙ্গে একবার দেখা করিতে হইবে।

৩৬

শশিমুখীর সঙ্গে বিনয়ের বিবাহ যেন একপ্রকার স্থির হইয়া গেছে এইভাবে মহিম এবং তাঁহার ঘরের লোকেরা চলিতেছিলেন। শশিমুখী তো বিনয়ের কাছেও আসিত না। শশিমুখীর মার সঙ্গে বিনয়ের পরিচয় ছিল না বলিলেই হয়। তিনি যে ঠিক লাজুক ছিলেন তাহা নহে, কিন্তু অস্বাভাবিক রকমের গোপনচারিণী ছিলেন। তাঁহার ঘরের দরজা প্রায়ই বন্ধ। স্বামী ছাড়া তাঁহার আর সমস্তই তালাচাবির মধ্যে। স্বামীও যে যথেষ্ট খোলা পাইতেন তাহা নহে– স্ত্রীর শাসনে তাঁহার গতিবিধি অত্যন্ত সুনির্দিষ্ট এবং তাঁহার সঞ্চরণক্ষেত্রের পরিধি নিতান্ত সংকীর্ণ ছিল। এইরূপ ঘের দিয়া লওয়ার স্বভাব-বশত শশিমুখীর মা লক্ষ্ণীমণির জগৎটি সম্পূর্ণ তাঁহার আয়ত্তের মধ্যে ছিল– সেখানে বাহিরের লোকের ভিতরে এবং ভিতরের লোকের বাহিরে যাওয়ার পথ অবারিত ছিল না। এমন-কি, গোরাও লক্ষ্ণীমণির মহলে তেমন করিয়া আমল পাইত না। এই রাজ্যের বিধিব্যবস্থার মধ্যে কোনো দ্বৈধ ছিল না। কারণ, এখানকার বিধানকর্তাও লক্ষ্ণীমণি এবং নিম্ন-আদালত হইতে আপিল-আদালত পর্যন্ত সমস্তই লক্ষ্ণীমণি– এক্‌জিক্যুটিভ এবং জুডিশিয়ালে তো ভেদ ছিলই না, লেজিস্‌লেটিভও তাহার সহিত জোড়া ছিল। বাহিরের লোকের সঙ্গে ব্যবহারে মহিমকে খুব শক্ত লোক বলিয়াই মনে হইত, কিন্তু লক্ষ্ণীমণির এলাকার মধ্যে তাঁহার নিজের ইচ্ছা খাটাইবার কোনো পথ ছিল না। সামান্য বিষয়েও না।

লক্ষ্ণীমণি বিনয়কে আড়াল হইতে দেখিয়াছিলেন, পছন্দও করিয়াছিলেন। মহিম বিনয়ের বাল্যকাল হইতে গোরার বন্ধুরূপে তাহাকে এমন নিয়ত দেখিয়া আসিয়াছেন যে, অতিপরিচয়বশতই তিনি বিনয়কে নিজের কন্যার পাত্র বলিয়া দেখিতেই পান নাই। লক্ষ্ণীমণি যখন বিনয়ের প্রতি তাঁহার দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন তখন সহধর্মিণীর বুদ্ধির প্রতি তাঁহার শ্রদ্ধা বাড়িয়া গেল। লক্ষ্ণীমণি পাকা করিয়াই স্থির করিয়া দিলেন যে, বিনয়ের সঙ্গেই তাঁহার কন্যার বিবাহ হইবে। এই প্রস্তাবের একটা মস্ত সুবিধার কথা তিনি তাঁহার স্বামীর মনে মুদ্রিত করিয়া দিলেন যে, বিনয় তাঁহাদের কাছ হইতে কোনো পণ দাবি করিতে পারিবে না।

বিনয়কে বাড়িতে পাইয়াও দুই-এক দিন মহিম তাহাকে বিবাহের কথা বলিতে পারেন নাই। গোরার কারাবাস-সম্বন্ধে তাহার মন বিষণ্ন ছিল বলিয়া তিনি নিরস্ত ছিলেন।

আজ রবিবার ছিল। গৃহিণী মহিমের সাপ্তাহিক দিবানিদ্রাটি সম্পূর্ণ হইতে দিলেন না। বিনয় নূতন-প্রকাশিত বঙ্কিমের “বঙ্গদর্শন’ লইয়া আনন্দময়ীকে শুনাইতেছিল– পানের ডিবা হাতে লইয়া সেইখানে আসিয়া মহিম তক্তপোশের উপরে ধীরে ধীরে বসিলেন।

প্রথমত বিনয়কে একটা পান দিয়া তিনি গোরার উচ্ছৃঙ্খল নির্‌বুদ্ধিতা লইয়া বিরক্তি প্রকাশ করিলেন। তাহার পরে তাহার খালাস হইতে আর কয়দিন বাকি তাহা আলোচনা করিতে গিয়া অত্যন্ত অকস্মাৎ মনে পড়িয়া গেল যে, অঘ্রান মাসের প্রায় অর্ধেক হইয়া আসিয়াছে।

কহিলেন, “বিনয়, তুমি যে বলেছিলে অঘ্রান মাসে তোমাদের বংশে বিবাহ নিষেধ আছে, সেটা কোনো কাজের কথা নয়। একে তো পাঁজিপুঁথিতে নিষেধ ছাড়া কথাই নেই, তার উপরে যদি ঘরের শাস্ত্র বানাতে থাক তা হলে বংশরক্ষা হবে কী করে?”

বিনয়ের সংকট দেখিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “শশিমুখীকে এতটুকুবেলা থেকে বিনয় দেখে আসছে– ওকে বিয়ে করার কথা ওর মনে লাগছে না; সেইজন্যেই অঘ্রান মাসের ছুতো করে বসে আছে।”

মহিম কহিলেন, “সে কথা তো গোড়ায় বললেই হত।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “নিজের মন বুঝতেও যে সময় লাগে। পাত্রের অভাব কী আছে মহিম। গোরা ফিরে আসুক– সে তো অনেক ভালো ছেলেকে জানে– সে একটা ঠিক করে দিতে পারবে।”

মহিম মুখ অন্ধকার করিয়া কহিলেন, “হুঁ।” খানিকক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন, তাহার পরে কহিলেন, “মা, তুমি যদি বিনয়ের মন ভাঙিয়ে না দিতে তা হলে ও এ কাজে আপত্তি করত না।”

বিনয় ব্যস্ত হইয়া কী একটা বলিতে যাইতেছিল, আনন্দময়ী বাধা দিয়া কহিলেন, “তা, সত্য কথা বলছি মহিম, আমি ওকে উৎসাহ দিতে পারি নি। বিনয় ছেলেমানুষ, ও হয়তো না বুঝে একটা কাজ করে বসতেও পারত, কিন্তু শেষকালে ভালো হত না।”

আনন্দময়ী বিনয়কে আড়ালে রাখিয়া নিজের ‘পরেই মহিমের রাগের ধাক্কাটা গ্রহণ করিলেন। বিনয় তাহা বুঝিতে পারিয়া নিজের দুর্বলতায় লজ্জিত হইয়া উঠিল। সে নিজের অসম্মতি স্পষ্ট করিয়া প্রকাশ করিতে উদ্যত হইলে মহিম আর অপেক্ষা না করিয়া মনে মনে এই বলিতে বলিতে বাহির হইয়া গেলেন যে, বিমাতা কখনো আপন হয় না।

মহিম যে এ কথা মনে করিতে পারেন এবং বিমাতা বলিয়া তিনি যে সংসারের বিচারক্ষেত্রে বরাবর আসামী-শ্রেণীতেই ভুক্ত আছেন আনন্দময়ী তাহা জানিতেন। কিন্তু লোকে কী মনে করিবে এ কথা ভাবিয়া চলা তাঁহার অভ্যাসই ছিল না। যেদিন তিনি গোরাকে কোলে তুলিয়া লইয়াছেন সেইদিন হইতেই লোকের আচার, লোকের বিচার হইতে তাঁহার প্রকৃতি একেবারে স্বতন্ত্র হইয়া গেছে। সেদিন হইতে তিনি এমন-সকল আচরণ করিয়া আসিয়াছেন যাহাতে লোকে তাঁহার নিন্দাই করে। তাঁহার জীবনের মর্মস্থানে যে একটি সত্যগোপন তাঁহাকে সর্বদা পীড়া দিতেছে লোকনিন্দায় তাঁহাকে সেই পীড়া হইতে কতকটা পরিমাণে মুক্তি দান করে। লোকে যখন তাঁহাকে খৃস্টান বলিত তিনি গোরাকে কোলে চাপিয়া ধরিয়া বলিতেন– “ভগবান জানেন খৃস্টান বলিলে আমার নিন্দা হয় না।’ এমনি করিয়া ক্রমে সকল বিষয়েই লোকের কথা হইতে নিজের ব্যবহারকে বিচ্ছিন্ন করিয়া লওয়া তাঁহার স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছিল। এইজন্য মহিম তাঁহাকে মনে মনে বা প্রকাশ্যে বিমাতা বলিয়া লাঞ্ছিত করিলেও তিনি নিজের পথ হইতে বিচলিত হইতেন না।

0 Shares