গোরা

এই বলিয়া গোরার সযত্নরক্ষিত চিঠিখানি বাক্স হইতে বাহির করিয়া সুচরিতার হাতে দিলেন। কহিলেন, “মা, তুমি চেঁচিয়ে পড়ো, আমি আর-এক বার শুনি।”

গোরার সেই আশ্চর্য চিঠিখানি পড়া হইয়া গেলে পর তিনজনেই কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ হইয়া রহিলেন। আনন্দময়ী তাঁহার চোখের প্রান্ত আঁচল দিয়া মুছিলেন। সে যে চোখের জল তাহাতে শুধু মাতৃহৃদয়ের ব্যথা নহে, তাহার সঙ্গে আনন্দ এবং গৌরব মিশিয়া ছিল। তাঁহার গোরা কি যে-সে গোরা! ম্যাজিস্ট্রেট তাহার কসুর মাপ করিয়া তাহাকে দয়া করিয়া ছাড়িয়া দিবেন, সে কি তেমনি গোরা! সে যে অপরাধ সমস্ত স্বীকার করিয়া জেলের দুঃখ ইচ্ছা করিয়া নিজের কাঁধে তুলিয়া লইয়াছে। তাহার সে দুঃখের জন্য কাহারো সহিত কোনো কলহ করিবার নাই। গোরা তাহা অকাতরে বহন করিতেছে এবং আনন্দময়ীও ইহা সহ্য করিতে পারিবেন।

ললিতা আশ্চর্য হইয়া আনন্দময়ীর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। ব্রাহ্মপরিবারের সংস্কার ললিতার মনে খুব দৃঢ় ছিল; যে মেয়েরা আধুনিক প্রথায় শিক্ষা পায় নাই এবং যাহাদিগকে সে “হিঁদুবাড়ির মেয়ে’ বলিয়া জানিত তাহাদের প্রতি ললিতার শ্রদ্ধা ছিল না। শিশুকালে বরদাসুন্দরী তাহাদের যে অপরাধের প্রতি লক্ষ করিয়া বলিতেন “হিঁদুবাড়ির মেয়েরাও এমন কাজে করে না’ সে অপরাধের জন্য ললিতা বরাবর একটু বিশেষ করিয়াই মাথা হেঁট করিয়াছে। আজ আনন্দময়ীর মুখের কয়টি কথা শুনিয়া তাহার অন্তঃকরণ বার বার করিয়া বিস্ময় অনুভব করিতেছে। যেমন বল তেমনি শান্তি, তেমনি আশ্চর্য সদ্‌বিবেচনা। অসংযত হৃদয়াবেগের জন্য ললিতা নিজেকে এই রমণীর কাছে খুবই খর্ব করিয়া অনুভব করিল। তাহার মনের ভিতরে আজ ভারি একটা ক্ষুব্ধতা ছিল, সেইজন্য সে বিনয়ের মুখের দিকে চায় নাই, তাহার সঙ্গে কথাও কয় নাই। কিন্তু আনন্দময়ীর স্নেহে করুণায় ও শান্তিতে মণ্ডিত মুখখানির দিকে চাহিয়া তাহার বুকের ভিতরকার সমস্ত বিদ্রোহের তাপ যেন জুড়াইয়া গেল–চারি দিকের সকলের সঙ্গে তাহার সম্বন্ধ সহজ হইয়া আসিল। ললিতা আনন্দময়ীকে কহিল, “গৌরবাবু যে এত শক্তি কোথা থেকে পেয়েছেন তা আপনাকে দেখে আজ বুঝতে পারলুম।”

আনন্দময়ী কহিলেন, “ঠিক বোঝ নি। গোরা যদি আমার সাধারণ ছেলের মতো হত তা হলে আমি কোথা থেকে বল পেতুম! তা হলে কি তার দুঃখ আমি এমন করে সহ্য করতে পারতুম।”

ললিতার মনটা আজ কেন যে এতটা বিকল হইয়া উঠিয়াছিল তাহার একটু ইতিহাস বলা আবশ্যক।

এ কয়দিন প্রত্যহ সকালে বিছানা হইতে উঠিয়াই প্রথম কথা ললিতার মনে এই জাগিয়াছে যে, আজ বিনয়বাবু আসিবেন না। অথচ সমস্ত দিনই তাহার মন এক মুহূর্তের জন্যও বিনয়ের আগমন প্রতীক্ষা করিতে ছাড়ে নাই। ক্ষণে ক্ষণে সে কেবলই মনে করিয়াছে বিনয় হয়তো আসিয়াছে, হয়তো সে উপরে না আসিয়া নীচের ঘরে পরেশবাবুর সঙ্গে কথা কহিতেছে। এইজন্য দিনের মধ্যে কতবার সে অকারণে এ ঘরে ও ঘরে ঘুরিয়াছে তাহার ঠিক নাই। অবশেষে দিন যখন অবসান হয়, রাত্রে যখন সে বিছানায় শুইতে যায়, তখন সে নিজের মনখানা লইয়া কী যে করিবে ভাবিয়া পায় না। বুক ফাটিয়া কান্না আসে–সঙ্গে সঙ্গে রাগ হইতে থাকে, কাহার উপরে রাগ বুঝিয়া উঠাই শক্ত। রাগ বুঝি নিজের উপরেই। কেবলই মনে হয়, “এ কী হইল! আমি বাঁচিব কি করিয়া! কোনো দিকে তাকাইয়া যে কোনো রাস্তা দেখিতে পাই না। এমন করিয়া কতদিন চলিবে!’

ললিতা জানে, বিনয় হিন্দু, কোনোমতেই বিনয়ের সঙ্গে তাহার বিবাহ হইতে পারে না। অথচ নিজের হৃদয়কে কোনোমতেই বশ মানাইতে না পারিয়া লজ্জায় ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেছে। বিনয়ের হৃদয় যে তাহার প্রতি বিমুখ নহে এ কথা সে বুঝিয়াছে; বুঝিয়াছে বলিয়াই নিজেকে সংবরণ করা তাহার পক্ষে আজ এত কঠিন হইয়াছে। সেইজন্যই সে যখন উতলা হইয়া বিনয়ের আশাপথ চাহিয়া থাকে সেইসঙ্গেই তাহার মনের ভিতরে একটা ভয় হইতে থাকে, পাছে বিনয় আসিয়া পড়ে। এমনি করিয়া নিজের সঙ্গে টানাটানি করিতে করিতে আজ সকালে তাহার ধৈর্য আর বাঁধ মানিল না। তাহার মনে হইল, বিনয় না আসাতেই তাহার প্রাণের ভিতরটা কেবলই অশান্ত হইয়া উঠিতেছে, একবার দেখা হইলেই এই অস্থিরতা দূর হইয়া যাইবে।

সকালবেলা সে সতীশকে নিজের ঘরের মধ্যে টানিয়া আনিল। সতীশ আজকাল মাসিকে পাইয়া বিনয়ের সঙ্গে বন্ধুত্বচর্চার কথা একরকম ভুলিয়াই ছিল। ললিতা তাহাকে কহিল, “বিনয়বাবুর সঙ্গে তোর বুঝি ঝগড়া হয়ে গেছে?”

সে এই অপবাদ সতেজে অস্বীকার করিল। ললিতা কহিল, “ভারি তো তোর বন্ধু! তুইই কেবল বিনয়বাবু বিনয়বাবু করিস, তিনি তো ফিরেও তাকান না।”

সতীশ কহিল, “ইস! তাই তো! কক্‌্‌খনো না!”

পরিবারের মধ্যে ক্ষুদ্রতম সতীশকে নিজের গৌরব সপ্রমাণ করিবার জন্য এমনি করিয়া বারংবার গলার জোর প্রয়োগ করিতে হয়। আজ প্রমাণকে তাহার চেয়েও দৃঢ়তর করিবার জন্য সে তখনই বিনয়ের বাসায় ছুটিয়া গেল। ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “তিনি যে বাড়িতে নেই, তাই জন্যে আসতে পারেন নি।”

ললিতা জিজ্ঞাসা করিল, “এ কদিন আসেন নি কেন?”

সতীশ কহিল, “কদিনই যে ছিলেন না।”

তখন ললিতা সুচরিতার কাছে গিয়া কহিল, “দিদিভাই, গৌরবাবুর মায়ের কাছে আমাদের কিন্তু একবার যাওয়া উচিত।”

সুচরিতা কহিল, “তাঁদের সঙ্গে যে পরিচয় নেই।”

ললিতা কহিল, “বাঃ, গৌরবাবুর বাপ যে বাবার ছেলেবেলাকার বন্ধু ছিলেন।”

0 Shares