গোরা

বিনয় এই কথাটকে থামিতে দিল না। নানা দিক দিয়া এই আলোচনাকে জাগ্রত করিয়া রাখিল। পরেশবাবুর মেয়েদের সম্বন্ধে কতদিনকার কত ছোটোখাটো ঘটনার কথা উঠিয়া পড়িল–তাহার অনেকগুলিই অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু সেই অগ্রহায়ণের ম্লানায়মান নিভৃত সন্ধ্যায় নিরালা ঘরে বিনয়ের উৎসাহ এবং আনন্দময়ীর ঔৎসুক্য-দ্বারা এই-সকল ক্ষুদ্র গৃহকোণের অখ্যাত ইতিহাসখণ্ড একটি গম্ভীর মহিমায় পূর্ণ হইয়া উঠিল।

আনন্দময়ী হঠাৎ এক সময়ে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিয়া উঠিলেন, “সুচরিতার সঙ্গে যদি গোরার বিয়ে হতে পারে তো বড়ো খুশি হই।”

বিনয় লাফাইয়া উঠিল, কহিল, “মা, এ কথা আমি অনেক বার ভেবেছি। ঠিক গোরার উপযুক্ত সঙ্গিনী।”

আনন্দময়ী। কিন্তু হবে কী?

বিনয়। কেন হবে না? আমার মনে হয় গোরা যে সুচরিতাকে পছন্দ করে না তা নয়।

গোরা মন যে কোনো এক জায়গায় আকৃষ্ট হইয়াছে আনন্দময়ীর কাছে তাহা অগোচর ছিল না। সে মেয়েটি যে সুচরিতা তাহাও তিনি বিনয়ের নানা কথা হইতে সংগ্রহ করিয়াছিলেন। খানিকক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আনন্দময়ী কহিলেন, “কিন্তু সুচরিতা কি হিন্দুর ঘরে বিয়ে করবে?”

বিনয় কহিল, “আচ্ছা মা, গোরা কি ব্রাহ্মর ঘরে বিয়ে করতে পারে না? তোমার কি তাতে মত নেই?”

আনন্দময়ী। আমার খুব মত আছে।

বিনয় পুনশ্চ জিজ্ঞাসা করিল, “আছে?”

আনন্দময়ী কহিলেন, “আছে বৈকি বিনু! মানুষের সঙ্গে মানুষের মনের মিল নিয়েই বিয়ে– সে সময়ে কোন্‌ মন্তরটা পড়া হল তা নিয়ে কী আসে যায় বাবা! যেমন করে হোক ভগবানের নামটা নিলেই হল।”

বিনয়ের মনের ভিতর হইতে একটা ভার নামিয়া গেল। সে উৎসাহিত হইয়া কহিল, “মা, তোমার মুখে যখন এ-সব কথা শুনি আমার ভারি আশ্চর্য বোধ হয়। এমন ঔদার্য তুমি পেলে কোথা থেকে!”

আনন্দময়ী হাসিয়া কহিলেন, “গোরার কাছ থেকে পেয়েছি।”

বিনয় কহিল, “গোরা তো এর উল্‌টো কথাই বলে!”

আনন্দময়ী। বললে কী হবে। আমার যা-কিছু শিক্ষা সব গোরা থেকেই হয়েছে। মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য–আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে, ঝগড়া করে মরে, তা যে কত মিথ্যে–সে কথা ভগবান গোরাকে যেদিন দিয়েছেন সেইদিনই বুঝিয়ে দিয়েছেন। বাবা, ব্রাহ্মই বা কে আর হিন্দুই বা কে। মানুষের হৃদয়ের তো কোনো জাত নেই–সেইখানেই ভগবান সকলকে মেলান এবং নিজে এসেও মেলেন। তাঁকে ঠেলে দিয়ে মন্তর আর মতের উপরেই মেলাবার ভার দিলে চলে কি?”

বিনয় আনন্দময়ীর পায়ের ধুলা লইয়া কহিল, “মা, তোমার কথা আমার বড়ো মিষ্টি লাগল। আমার দিনটা আজ সার্থক হয়েছে।”

৩৭

সুচরিতার মাসি হরিমোহিনীকে লইয়া পরেশের পরিবারে একটা গুরুতর অশান্তি উপস্থিত হইল। তাহা বিবৃত করিয়া বলিবার পূর্বে, হরিমোহিনী সুচরিতার কাছে নিজের যে পরিচয় দিয়াছিলেন তাহাই সংক্ষেপ করিয়া নীচে লেখা গেল–

আমি তোমার মায়ের চেয়ে দুই বছরের বড়ো ছিলাম। বাপের বাড়িতে আমাদের দুইজনের আদরের সীমা ছিল না। কেননা, তখন আমাদের ঘরে কেবল আমরা দুই কন্যাই জন্মগ্রহণ করিয়াছিলাম–বাড়িতে আর শিশু কেহ ছিল না। কাকাদের আদরে আমাদের মাটিতে পা ফেলিবার অবকাশ ঘটিত না।

আমার বয়স যখন আট তখন পালসার বিখ্যাত রায়চৌধুরীদের ঘরে আমার বিবাহ হয়। তাঁহারা কুলেও যেমন ধনেও তেমন। কিন্তু আমার ভাগ্যে সুখ ঘটিল না। বিবাহের সময় খরচ-পত্র লইয়া আমার শ্বশুরের সঙ্গে পিতার বিবাদ বাধিয়াছিল। আমার পিতৃগৃহের সেই অপরাধ আমার শ্বশুরবংশ অনেক দিন পর্যন্ত ক্ষমা করিতে পারেন নাই। সকলেই বলিত–আমাদের ছেলের আবার বিয়ে দেব, দেখি ও মেয়েটার কী দশা হয়। আমার দুর্দশা দেখিয়াই বাবা প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, কখনো ধনীর ঘরে মেয়ে দিবেন না। তাই তোমার মাকে গরিবের ঘরেই দিয়াছিলেন।

বহু পরিবারের ঘর ছিল, আমাকে আট-নয় বৎসর বয়সের সময়েই রান্না করিতে হইত। প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক খাইত। সকলের পরিবেশনের পরে কোনোদিন শুধু ভাত, কোনোদিন বা ডালভাত খাইয়াই কাটাইতে হইত। কোনোদিন বেলা দুইটার সময়ে, কোনোদিন বা একেবারে বেলা গেলে আহার করিতাম। আহার করিয়াই বৈকালের রান্না চড়াইতে যাইতে হইত। রাত এগারোটা বারোটার সময় খাইবার অবকাশ ঘটিত। শুইবার কোনো নির্দিষ্ট জায়গা ছিল না। অন্তঃপুরে যাহার সঙ্গে যেদিন সুবিধা হইত তাহার সঙ্গেই শুইয়া পড়িতাম। কোনোদিন বা পিঁড়ি পাতিয়া নিদ্রা দিতে হইত।

বাড়িতে আমার প্রতি সকলের যে অনাদর ছিল আমার স্বামীর মনও তাহাতে বিকৃত না হইয়া থাকিতে পারে নাই। অনেক দিন পর্যন্ত তিনি আমাকে দূরে দূরেই রাখিয়াছিলেন।

এমন সময়ে আমার বয়স যখন সতেরো তখন আমার কন্য মনোরমা জনন্মগ্রহণ করে। মেয়েকে জন্ম দেওয়াতে শ্বশুরকুলে আমার গঞ্জনা আরো বাড়িয়া গিয়াছিল। আমার সকল অনাদর সকল লাঞ্ছনার মধ্যে এই মেয়েটিই আমার একমাত্র সান্ত্বনা ও আনন্দ ছিল। মনোরমাকে তাহার বাপ এবং আর কেহ তেমন করিয়া আদর করে নাই বলিয়াই সে আমার প্রাণপণ আদরের সামগ্রী হইয়া উঠিয়াছিল।

তিন বৎসর পরে যখন আমার একটি ছেলে হইল তখন হইতে আমার অবস্থার পরিবর্তন হইতে লাগিল। তখন আমি বাড়ির গৃহিনী বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য হইলাম। আমার শাশুড়ি ছিলেন না–আমার শ্বশুরও মনোরমা জন্মিবার দুই বৎসর পরেই মারা যান। তাঁহার মৃত্যুর পরেই বিষয় লইয়া দেবরদের সঙ্গে মকদ্দমা বাধিয়া গেল। অবশেষে মামলায় অনেক সম্পত্তি নষ্ট করিয়া আমরা পৃথক হইলাম।

0 Shares