গোরা

হরিমোহিনী যখন দেখিলেন জলের অসুবিধা হইতেছে তখন তিনি রন্ধন একেবারে ছাড়িয়াই দিলেন। তাঁহার ঠাকুরের কাছে নিবেদন করিয়া প্রসাদস্বরূপে দুধ এবং ফল খাইয়া কাটাইতে লাগিলেন। সুচরিতা ইহাতে অত্যন্ত কষ্ট পাইল। মাসি তাহাকে অনেক করিয়া বুঝাইয়া বলিলেন, “মা, এ আমার বড়ো ভালো হয়েছে। এই আমার প্রয়োজন ছিল। এতে আমার কোনো কষ্ট নেই, আমার আনন্দই হয়।”

সুচরিতা কহিল, “মাসি, আমি যদি অন্য জাতের হাতে জল বা খাবার না খাই তা হলে তুমি আমাকে তোমার কাজ করতে দেবে?”

হরিমোহিনী কহিলেন, “কেন মা, তুমি যে ধর্ম মান সেই মতেই তুমি চলো– আমার জন্যে তোমাকে অন্য পথে যেতে হবে না। আমি তোমাকে কাছে পেয়েছি, বুকে রাখছি, প্রতিদিন দেখতে পাই, এই আমার আনন্দ। পরেশবাবু তোমার গুরু, তোমার বাপের মতো, তিনি তোমাকে যে শিক্ষা দিয়েছেন তুমি সেই মেনে চলো, তাতেই ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।”

হরিমোহিনী বরদাসুন্দরীর সমস্ত উপদ্রব এমন করিয়া সহিতে লাগিলেন যেন তাহা তিনি কিছুই বুঝিতে পারেন নাই। পরেশবাবু যখন প্রত্যহ আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিতেন– কেমন আছেন, কোনো অসুবিধা হইতেছে না তো– তিনি বলিতেন, “আমি খুব সুখে আছি।”

কিন্তু বরদাসুন্দরীর সমস্ত অন্যায় সুচরিতাকে প্রতি মুহূর্তে জর্জরিত করিতে লাগিল। সে তো নালিশ করিবার মেয়ে নয়; বিশেষত পরেশবাবুর কাছে বরদাসুন্দরীর ব্যবহারের কথা বলা তাহার দ্বারা কোনোমতেই ঘটিতে পারে না। সে নিঃশব্দে সমস্ত সহ্য করিতে লাগিল– এ সম্বন্ধে কোনোপ্রকার আক্ষেপ প্রকাশ করিতেও তাহার অত্যন্ত সংকোচ বোধ হইত।

ইহার ফল হইল এই যে, সুচরিতা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবেই তাহার মাসির কাছে আসিয়া পড়িল। মাসির বারংবার নিষেধসত্ত্বেও আহার-পান সম্বন্ধে সে তাঁহারই সম্পূর্ণ অনুবর্তী হইয়া চলিতে লাগিল। শেষকালে সুচরিতার কষ্ট হইতেছে দেখিয়া দায়ে পড়িয়া হরিমোহিনীকে পুনরায় রন্ধনাদিতে মন দিতে হইল। সুচরিতা কহিল, “মাসি, তুমি আমাকে যেমন করে থাকতে বল আমি তেমনি করেই থাকব, কিন্তু তোমার জল আমি নিজে তুলে দেব, সে আমি কিছুতেই ছাড়ব না।”

হরিমোহিনী কহিলেন, “মা, তুমি কিছুই মনে কোরো না, কিন্তু ঐ জলে যে আমার ঠাকুরের ভোগ হয়।”

সুচরিতা কহিল, “মাসি, তোমার ঠাকুরও কি জাত মানেন? তাঁকেও কি পাপ লাগে? তাঁরও কি সমাজ আছে না কি?’

অবশেষে একদিন সুচরিতার নিষ্ঠার কাছে হরিমোহিনীকে হার মানিতে হইল। সুচরিতার সেবা তিনি সম্পূর্ণভাবেই গ্রহণ করিলেন। সতীশও দিদির অনুকরণে “মাসির রান্না খাইব’ বলিয়া ধরিয়া পড়িল। এমনি করিয়া এই তিনটিতে মিলিয়া পরেশবাবুর ঘরের কোণে আর-একটি ছোটো সংসার জমিয়া উঠিল। কেবল ললিতা এই দুটি সংসারের মাঝখানে সেতুস্বরূপে বিরাজ করিতে লাগিল। বরদাসুন্দরী তাঁহার আর-কোনো মেয়েকে এ দিকে ঘেঁষিতে দিতেন না– কিন্তু ললিতাকে নিষেধ করিয়া পারিয়া উঠিবার শক্তি তাঁহার ছিল না।

৩৯

বরদাসুন্দরী তাঁহার ব্রাহ্মিকাবন্ধুদিগকে প্রায়ই নিমন্ত্রণ করিতে লাগিলেন। মাঝে মাঝে তাঁহাদের ছাদের উপরেই সভা হইত। হরিমোহিনী তাঁহার স্বাভাবিক গ্রাম্য সরলতার সহিত মেয়েদের আদর-অভ্যর্থনা করিতে চেষ্টা করিতেন, কিন্তু ইহারা যে তাঁহাকে অবজ্ঞা করে তাহা তাঁহার কাছে গোপন রহিল না। এমন-কি, হিন্দুদের সামাজিক আচার-ব্যবহার লইয়া তাঁহার সমক্ষেই বরদাসুন্দরী তীব্র সমালোচনা উত্থাপিত করিতেন এবং অনেক রমণী হরিমোহিনীর প্রতি বিশেষ লক্ষ রাখিয়া সেই সমালোচনায় যোগ দিতেন।

সুচরিতা তাহার মাসির কাছে থাকিয়া এ-সমস্ত আক্রমণ নীরবে সহ্য করিত। কেবল, সেও যে তাহার মাসির দলে ইহাই সে যেন গায়ে পড়িয়া প্রকাশ করিতে চেষ্টা করিত। যেদিন আহারের আয়োজন থাকিত সেদিন সুচরিতাকে সকলে খাইতে ডাকিলে সে বলিত, “না, আমি খাই নে।”

“সে কী! তুমি বুঝি আমাদের সঙ্গে বসে খাবে না!”

“না!”

বরদাসুন্দরী বলিতেন, “আজকাল সুচরিতা যে মস্ত হিঁদু হয়ে উঠেছেন, তা বুঝি জান না? উনি যে আমাদের ছোঁওয়া খান না।”

“সুচরিতাও হিঁদু হয়ে উঠল! কালে কালে কতই যে দেখতে হবে তাই ভাবি।”

হরিমোহিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিতেন, “রাধারানী মা, যাও মা! তুমি খেতে যাও মা!”

দলের লোকের কাছে যে সুচরিতা তাঁহার জন্য এমন করিয়া খোঁটা খাইতেছে ইহা তাঁহার কাছে অত্যন্ত কষ্টকর হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সুচরিতা অটল হইয়া থাকিত। একদিন কোনো ব্রাহ্ম মেয়ে কৌতূহলবশত হরিমোহিনীর ঘরের মধ্যে জুতা লইয়া প্রবেশ করিতে প্রবৃত্ত হইলে সুচরিতা পথরোধ করিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “ও ঘরে যেয়ো না।”

“কেন?”

“ও ঘরে ওঁর ঠাকুর আছে।”

“ঠাকুর আছে! তুমি বুঝি রোজ ঠাকুর পুজো কর।”

হরিমোহিনী বলিলেন, “হাঁ মা, পুজো করি বৈকি।”

“ঠাকুরকে তোমার ভক্তি হয়?”

“পোড়া কপাল আমার! ভক্তি আর কই হল! ভক্তি হলে তো বেঁচেই যেতুম।”

সেদিন ললিতা উপস্থিত ছিল। সে মুখ লাল করিয়া প্রশ্নকারিণীকে জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি যাঁর উপাসনা কর তাঁকে ভক্তি কর?”

“বাঃ, ভক্তি করি নে তো কী!”

ললিতা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “ভক্তি তো করই না, আর ভক্তি যে কর না সেটা তোমার জানাও নেই।”

সুচরিতা যাহাতে আচার-ব্যবহারে তাহার দল হইতে পৃথক না হয় সেজন্য হরিমোহিনী অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারিলেন না।

0 Shares