ঘরে বাইরে

সন্দীপ বললে, আজ বাংলাদেশে যেখানে যত ধন আছে সমস্তর ‘পরেই আমার লোভ। লোভের মতো এত বড়ো মহৎ বৃত্তি কি আর-কিছু আছে? পৃথিবীর যারা ইন্দ্র লোভ তাদের ঐরাবত।– তা হলে এ সমস্ত গয়না আমার?

এই ব’লে সন্দীপ বাক্সটি তুলে নিয়ে শালের মধ্যে ঢাকা দিতেই অমূল্য ঘরের মধ্যে ঢুকল। তার চোখের গোড়ায় কালি পড়েছে, মুখ শুকনো, উষ্কখুষ্ক চুল; একদিনেই তার তরুণ-বয়েসের লাবণ্য যেন ঝরে গিয়েছে। তাকে দেখবামাত্রই আমার বুকের ভিতরটায় কামড়ে উঠল।

অমূল্য আমার দিকে না তাকিয়েই একেবারে সন্দীপকে গিয়ে বললে, আপনি গয়নার বাক্স আমার তোরঙ্গ থেকে বের করে এনেছেন?

গয়নার বাক্স তোমারই নাকি?

না, কিন্তু তোরঙ্গ আমার।

সন্দীপ হা হা ক’রে হেসে উঠল। বললে, তোরঙ্গ সম্বন্ধে আমি-তুমির ভেদবিচার তো তোমার বড়ো সূক্ষ্ম হে অমূল্য! তুমিও মরবার আগে ধর্মপ্রচারক হয়ে মরবে দেখছি।

অমূল্য চৌকির উপর বসে পড়ে দুই হাতে মুখ ঢেকে টেবিলের উপর মাথা রাখলে। আমি তার কাছে এসে তার মাথায় হাত রেখে বললুম, অমূল্য, কী হয়েছে?

তখনই সে দাঁড়িয়ে উঠে বললে, দিদি, এ গয়নার বাক্স আমিই নিজের হাতে তোমাকে এনে দেব এই আমার সাধ ছিল, সন্দীপবাবু তা জানতেন, তাই উনি তাড়াতাড়ি–

আমি বললুম, কী হবে আমার ঐ গয়নার বাক্স নিয়ে? ও যাক-না, তাতে ক্ষতি কী?

অমূল্য বিস্মিত হয়ে বললে, যাবে কোথায়?

সন্দীপ বললে, এ গয়না আমার, এ আমার রানীর দেওয়া অর্ঘ্য।

অমূল্য পাগলের মতো বলে উঠল, না না না, কখনোই না! দিদি, এ আমি তোমাকে ফিরিয়ে এনে দিয়েছি, এ তুমি আর কাউকে দিতে পারবে না।

আমি বললুম, ভাই, তোমার দান চিরদিন আমার মনে রইল, কিন্তু গয়নায় যার লোভ সে নিয়ে যাক-না।

অমূল্য তখন হিংস্র জন্তুর মতো সন্দীপের দিকে তাকিয়ে গুমরে গুমরে বললে, দেখুন সন্দীপবাবু, আপনি জানেন, আমি ফাঁসিকে ভয় করি নে। এ গয়নার বাক্স যদি আপনি নেন–

সন্দীপ বিদ্রূপের হাসি হাসবার চেষ্টা করে বললে, অমূল্য, তোমারও এত দিনে জানা উচিত তোমার শাসনকে আমি ভয় করি নে; মক্ষীরানী, এ গয়না আজ অমি নেব বলে আসি নি, তোমাকে দেব বলেই এসেছিলুম। কিন্তু আমার জিনিস তুমি যে অমূল্যর হাত থেকে নেবে সেই অন্যায় নিবারণ করবার জন্যেই প্রথমে এ বাক্সে আমার দাবি স্পষ্ট করে তোমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলুম। এখন আমার এই জিনিস তোমাকে আমি দান করি। এই রইল। এবারে ঐ বালকের সঙ্গে তুমি বোঝা-পড়া করো, আমি চললুম। কিছুদিন থেকে তোমাদের দুজনের মধ্যে বিশেষ কথা চলছে, আমি তার মধ্যে নেই, যদি কোনো বিশেষ ঘটনা ঘ’টে ওঠে আমাকে দোষ দিতে পারবে না। অমূল্য, তোমার তোরঙ্গ বই প্রভৃতি যা-কিছু আমার ঘরে ছিল সমস্তই বাজারে তোমার বাসাঘরে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ঘরে তোমার কোনো জিনিস রাখা চলবে না।

এই বলে সন্দীপ তাড়াতাড়ি ঘর থেকে চলে গেল।

আমি বললুম, অমূল্য, তোমাকে আমার গয়না বিক্রি করতে দিয়ে অবধি মনে আমার শান্তি ছিল না।

কেন দিদি?

আমার ভয় হচ্ছিল এ গয়নার বাক্স নিয়ে পাছে তুমি বিপদে পড়, পাছে তোমাকে কেউ চোর বলে সন্দেহ করে ধরে। আমার সে ছ-হাজার টাকায় কাজ নেই। এখন আমার একটি কথা তোমাকে শুনতে হবে– এখনই তুমি বাড়ি যাও, যাও তোমার মায়ের কাছে।

অমূল্য চাদরের ভিতর তেকে একটা পুঁটলি বের করে বললে, দিদি, ছ-হাজার টাকা এনেছি।

জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় পেলে?

তার কোনো উত্তর না দিয়ে বললে, গিনির জন্যে অনেক চেষ্টা করলুম, সে হল না, তাই নোট এনেছি।

অমূল্য, মাথা খাও, সত্যি করে বলো, এ টাকা কোথায় পেলে?

সে আপনাকে বলব না।

আমি চোখে যে অন্ধকার দেখতে লাগলুম। বললুম, কী কাণ্ড করেছ অমূল্য? এ টাকা কি–

অমূল্য বলে উঠল, আমি জানি তুমি বলবে এ টাকা আমি অন্যায় করে এনেছি– আচ্ছা, তাই স্বীকার। কিন্তু যতবড়ো অন্যায় ততবড়োই দাম, সে দাম আমি দিয়েছি। এখন এ টাকা আমার।

এ টাকার সমস্ত বিবরণ আমার আর শুনতে ইচ্ছে হল না। শিরগুলো সংকুচিত হয়ে আমার সমস্ত শরীরকে যেন গুটিয়ে আনতে লাগল। আমি বললুম, নিয়ে যাও অমূল্য, এ টাকা যেখান থেকে নিয়ে এসেছ এখনই সেখানে দিয়ে এসো।

সে যে বড়ো শক্ত কথা।

না, শক্ত নয় ভাই। কী কুক্ষণে তুমি আমার কাছে এসেছিলে। সন্দীপও তোমার যতবড়ো অনিষ্ট করতে পারে নি আমি তাই করলুম!

সন্দীপের নামটা যেন তাকে খোঁচা মারলে। সে বললে, সন্দীপ! তোমার কাছে এলুম বলেই তো ওকে চিনতে পেরেছি। জানো দিদি, তোমার কাছ থেকে সেদিন ও যে ছ-হাজার টাকার গিনি নিয়ে গেছে তার থেকে এক পয়সাও খরচ করে নি। এখান থেকে গিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে রুমাল থেকে সমস্ত গিনি মেজের উপর ঢেলে রাশ করে তুলে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। বললে, এ টাকা নয়, এ ঐশ্বর্য-পারিজাতের পাপড়ি, এ অলকাপুরীর বাঁশি থেকে সুরের মতো ঝরে পড়তে পড়তে শক্ত হয়ে উঠেছে, একে তো ব্যাঙ্ক্‌নোটে ভাঙানো চলে না। এ যে সুন্দরীর কণ্ঠহার হয়ে থাকবার কামনা করছে — ওরে অমুল্য, তোরা একে স্থূলদৃষ্টিতে দেখিস নে, এ হচ্ছে লক্ষ্মীর হাসি, ইন্দ্রাণীর লাবণ্য– না না, ঐ অরসিক নায়েবটার হাতে পড়বার জন্যে এর সৃষ্টি হয় নি। দেখো অমূল্য, নায়েবটা নিছক মিথ্যা কথা বলেছে, পুলিস সেই নৌকোচুরির কোনো খবর পায় নি, ও এই সুযোগে কিছু করে নিতে চায়। দেখো অমূল্য, নায়েবের কাছ থেকে সেই চিঠি-তিনটে আদায় করতে হবে।– আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কেমন করে? — সন্দীপ বললে, জোর ক’রে, ভয় দেখিয়ে।– আমি বললুম, রাজি আছি, কিন্তু এই গিনিগুলি ফিরিয়ে দিতে হবে। — সন্দীপ বললে, আচ্ছা, সে হবে। — কেমন করে ভয় দেখিয়ে নায়েবের কাছ থেকে সেই চিঠিগুলি আদায় করে পুড়িয়ে ফেলেছি সে অনেক কথা। সেই রাত্রেই আমি সন্দীপের কাছে এসে বলেছি, আর ভয় নেই, গিনিগুলি আমাকে দিন, কাল সকালেই আমি দিদিকে ফিরিয়ে দেব।– সন্দীপ বললে, এ কোন্‌ মোহ তোমাকে পেয়ে বসল! এবার দিদির আঁচলে দেশ ঢাকা পড়ল বুঝি! বলো বন্দেমাতরং! ঘোর কেটে যাক। — তুমি তো জান দিদি, সন্দীপ কী মন্ত্র জানে। গিনি তারই কাছে রইল। আমি অন্ধকার-রাত্রে পুকুরের ঘাটের চাতালের উপর বসে বন্দেমাতরং জপতে লাগলুম। কাল যখন তুমি গয়না বেচতে দিলে তখন সন্ধ্যার সময় আবার ওর কাছে গেলুম। বেশ বুঝলুম, তখন ও আমার উপরে রাগে জ্বলছে। সে রাগ প্রকাশ করলে না; বললে দেখো, যদি আমার কোনো বাক্সয় সে গিনি থাকে তো নিয়ে যাও। বলে আমার গায়ের উপর চাবির গোছাটা ফেলে দিলে। কোথাও নেই। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কোথায় রেখেছেন বলুন। সন্দীপ বললে, আগে তোমার মোহ ভাঙবে, তারপরে আমি বলব। এখন নয়।– আমি দেখলুম, কিছুতেই তাকে নড়াতে পারব না, তখন আমাকে অন্য উপায় নিতে হয়েছিল। এর পরেও ওকে এই ছ হাজার টাকার নোট দেখিয়ে সেই গিনি-ক’টা নেবার অনেক চেষ্টা করেছি। গিনি এনে দিচ্ছি বলে আমাকে ভুলিয়ে রেখে ওর শোবার ঘর থেকে আমার তোরঙ্গ ভেঙে গয়নার বাক্স নিয়ে তোমার কাছে এসেছে! এ বাক্স তোমার কাছে আমাকে নিয়ে আসতে দিলে না! আবার বলে কিনা, এ গয়না ওরই দান! আমাকে যে কতখানি বঞ্চিত করেছে সে আমি কাকে বলব! এ আমি কখনো মাপ করতে পারব না। দিদি, ওর মন্ত্র একেবারে ছুটে গেছে। তুমিই ছুটিয়ে দিয়েছ।

0 Shares