চার অধ্যায়

“এখানে তোমার মেয়াদ কতদিনের?”

“আন্দাজ করছি চব্বিশ ঘণ্টা। ওই আঙিনায় রসে-বিগলিত নানা রঙের লীলা সমানে চলবে দিনের পর দিন, অতীন্দ্র বিলীন হয়ে যাবে পাণ্ডুবর্ণ দূরদিগন্তে। আমার ছোঁয়াচ লেগেছে যে-মাড়োয়ারিকে তাকে বেড়ি-পরা মহামারীতে না পায় এই আমি কামনা করি। এখনও বিনা মূলধনে আমার ভাগ্যভাগী হবার সম্ভাবনা যে তার নেই তা বলতে পারি নে।”

“তোমার ভবিষ্যৎ ঠিকানাটা?”

“হুকুম নেই বলবার।”

“তাহলে কি কল্পনাও করতে পারব না তুমি আছ কোথায়?”

“কল্পনা করতে দোষ কী। মানস-সরোবরের তীরটা ভালো জায়গা।”

ইতিমধ্যে ঝুলির ভিতর থেকে বইগুলো বের করে এলা উলটেপালটে দেখছে। কাব্য, তার কিছু ইংরেজি, আর দুই-একখানা বাংলা।

অতীন বললে, “এতদিন এগুলো বয়ে বেড়িয়েছি পাছে নিজের জাত ভুলি। ওরই বাণীলোকে ছিল আমার আদি বসতি। পাতা খুললেই পেনসিলে চিহ্নিত তার রাস্তা-গলির নির্দেশ পাবে। আর আজ! এই দেখো চেয়ে।”

এলা হঠাৎ মাটিতে লুটিয়ে অতীনের পা জড়িয়ে ধরলে। বললে, “মাপ করো, অন্তু, আমাকে মাপ করো।”

“তোমাকে মাপ করবার কী আছে এলী? ভগবান যদি থাকেন, তাঁর যদি থাকে অসীম দয়া তবে তিনি যেন আমাকে মাপ করেন।”

“যখন তোমাকে চিনতুম না তখন তোমাকে এই রাস্তায় দাঁড় করিয়েছি।”

অতীন হেসে উঠে বললে, “নিজেরই পাগলামির ফুল স্টীমে এই অস্থানে পৌঁচেছি সে খ্যাতিটুকুও দেবে না আমাকে? আমাকে নাবালকের কোঠায় ফেলে অভিভাবকগিরি করতে এলে আমি সইব না বলে রাখছি। তার চেয়ে মঞ্চ থেকে নেবে এস; আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলো– এস এস বঁধু এস আধো আঁচরে বসো।”

“হয়তো বলতুম কিন্তু আজ তুমি এমন করে খেপে উঠলে কেন?”

“খেপব না? বললে কিনা ভুজমৃণালের জোরে তুমি আমাকে পথে বের করেছ!”

“সত্যি কথা বললে রাগ কর কেন?”

“সত্যি কথা হল? আমি ছিটকে পড়েছি রাস্তায় অন্তরের বেগে, তুমি উপলক্ষ্যমাত্র। অন্য কোনো শ্রেণীর বঙ্গমহিলাকে উপলক্ষ্য পেলে এতদিনে গোরা-কালা-সম্মিলনী ক্লাবে ব্রিজ খেলতে যেতুম, ঘোড়দৌড়ের মাঠে গবর্নরের বক্সের অভিমুখে স্বর্গারোহণপর্বের সাধনা করতুম। যদি প্রমাণ হয় আমি মূঢ় তবে জাঁক করে বলব সে মূঢ়তা স্বয়ং আমারই, যাকে বলে ভগবদ্দত্ত প্রতিভা।”

“অন্তু, দোহাই তোমার, আর বাজে বকুনি বকো না! তোমার জীবিকা আমিই ভাসিয়ে দিয়েছি এ দুঃখ কখনো ভুলতে পারব না। দেখতে পাচ্ছি তোমার জীবনের মূল গেছে ছিন্ন হয়ে।”

“এতক্ষণে সেই মেয়ের প্রকাশ হয়, যে-মেয়েটি রিয়ল্‌। একটুকুতেই ধরা পড়ে দেশোদ্ধারের রঙ্গমঞ্চে তুমি রোম্যান্টিক। যে-সংসারে কাঁসার থালায় দুধভাত মাছের মুড়ো তারই কেন্দ্রে বসে আছ তালপাতার পাখা হাতে। যেখানে পোলেটিক্যাল ঠ্যাঙার গুঁতি সেখানে আলুথালু চুলে চোখদুটো পাকিয়ে এসে পড় অপ্রকৃতিস্থতার ঝোঁকে, সহজবুদ্ধি নিয়ে নয়।”

“এত কথাও বলতে পার, অন্তু, মেয়েমানুষও তোমার কাছে হার মানে।”

“মেয়েমানুষ কথা বলতে পারে নাকি! তারা তো শুধু বকে। কথার টর্নেডো দিয়ে সনাতন মূঢ়তার ভিত ভাঙব বলে একদিন মনের মধ্যে ঝোড়ো মেঘ জমে উঠেছিল। সেই মূঢ়তার উপরেই তোমাদের জয়স্তম্ভ গাঁথতে বেরিয়েছ কেবল গায়ের জোরে।”

“তোমার পায়ে পড়ি আমাকে বুঝিয়ে দাও আমার ভুলে তুমি ভুল কেন করলে? কেন নিলে জীবিকাবর্জনের দুঃখ?”

“ওটা আমার ব্যঞ্জনা, ইংরেজিতে যাকে বলে জেস্‌চার। ওটা আমার নিদেনকালের ভাষা। যদি দুঃখ না মানতুম তাহলে মুখ ফিরিয়ে চলে যেতে, কিছুতে বুঝতে না তোমাকে কতখানি ভালোবেসেছি। সেই কথাটা উড়িয়ে দিয়ে বলো না ওটা দেশকে ভালোবাসা।”

“দেশ এর মধ্যে নেই অন্তু?”

“দেশের সাধনা আর তোমার সাধনা এক হয়েছে বলেই দেশ এর মধ্যে আছে। একদিন বীর্যের জোরে যোগ্যতা দেখিয়ে পেতে হত মেয়েকে। আজ সেই মরণপণের সুযোগ পেয়েছি। সে-কথাটা ভুলে সামান্য আমার জীবিকার অভাব নিয়ে তোমার ব্যথা লেগেছে অন্নপূর্ণা!”

“আমারা মেয়েরা সাংসারিক। সংসারে অকুলোন সইতে পারি নে। আমার একটা কথা তোমাকে রাখতেই হবে। আমার আছে পৈতৃক বাড়ি, আরও আছে কিছু জমা টাকা। দোহাই তোমার, বার বার দোহাই দিচ্ছি, কথা রাখো, আমার কাছে টাকা নিতে সংকোচ করো না। জানি তোমার খুবই দরকার।”

“খুবই দরকার পড়লে ম্যাট্‌রিকুলেশনের নোটবই লেখা থেকে আরম্ভ করে কুলিগিরি পর্যন্ত খোলা রয়েছে।”

“আমি মানছি, অন্তু, আমার সমস্ত জমা টাকা দেশের কাজে এতদিনে খরচ করে ফেলা উচিত ছিল। কিন্তু উপার্জনে আমাদের সুযোগ কম বলেই সঞ্চয়ে আমাদের অন্ধ আসক্তি। ভীতু আমরা।”

“ওটা তোমাদের সহজবুদ্ধির উপদেশ। নিঃসস্বলতায় মেয়েদের শ্রী নষ্ট হয়।”

“আমাদের ছোটো নীড়, সেখানে টুকিটাকি কিছু আমরা জমা করি। কিন্তু সে তো কেবল বাঁচবার প্রয়োজনে নয়, ভালোবাসার প্রয়োজনে। আমার যা-কিছু সমস্তই তোমার জন্যে এ-কথা যদি বুঝিয়ে দিতে পারি তাহলে বাঁচি।”

“কিছুতেই বুঝব না ও-কথাটা। আজ পর্যন্ত মেয়েরা জুগিয়েছে সেবা, পুরুষরা জুগিয়েছে জীবিকা। তার বিপরীত ঘটলে মাথা হেঁট হয়। যে-চাওয়া নিয়ে অসংকোচে তোমার কাছে হাত পাততে পারি তাকে ঠেকিয়ে দিয়ে তুমি পণের বাঁধ বেঁধেছে। সেদিন নারায়ণী ইস্কুলের খাতা নিয়ে হিসেব মেলাচ্ছিলে। বসে পড়লুম কাছে, ঝড়ের ঘা খেয়ে চিল যেমন ধুলায় পড়ে তেমনি। মার-খাওয়া মন নিয়ে এসেছিলুম। কর্তব্যের যেমন-তেমন একটা ছাপমারা জিনিসে মেয়েদের নিষ্ঠা পাণ্ডার পায়ে তাদের অটল ভক্তির মতোই, ছাড়িয়ে নেওয়া অসম্ভব। মুখ তুলে চাইলে না। বসে বসে এক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে ইচ্ছা করছিলুম ওই সুকুমার আঙুলগুলির ডগা দিয়ে স্পর্শসুধা পড়ুক ঝরে আমার দেহে মনে। দরদ লাগল না তোমার কোনোখানেই; কৃপণ, সেটুকুও দিতে পারলে না! মনে মনে বললুম, আরও বেশি দাম দিতে হবে বুঝি। একদিন ফাটা মাথা কাটা দেহ নিয়ে পড়ব মাটিতে, তখন ভেঙে-পড়া প্রাণটাকে নেবে তোমার কোলে তুলে।”

0 Shares