চার অধ্যায়

এলা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে, বললে, “ফিরে এস অন্তু।”

“আর ফেরবার পথ নেই।”

“কেন নেই?”

“অজায়গায় যদি এসে পড়ি সেখানকারও দায়িত্ব আছে শেষ পর্যন্ত।”

এলা অতীনের গলা জড়িয়ে ধরে বললে, “ফিরে এস, অন্তু। এত বছর ধরে যে-বিশ্বাসের মধ্যে বাসা নিয়েছিলুম তার ভিত তুমি ভেঙে দিয়েছ। আজ আছি ভেসে-চলা ভাঙা নৌকো আঁকড়িয়ে। আমাকেও উদ্ধার করে নিয়ে যাও। –অমন চুপ করে বসে থেকো না, বলো অন্তু, একটা কথা বলো। এখনই তুমি হুকুম করো আমি ভাঙব পণ। ভুল করেছি আমি। আমাকে মাপ করো।”

“উপায় নেই।”

“কেন উপায় নেই? নিশ্চয় আছে।”

“তীর লক্ষ্য হারাতে পারে তূণে ফিরতে পারে না।”

“আমি স্বয়ংবরা, আমাকে বিয়ে করো অন্তু। আর সময় নষ্ট করতে পারব না– গান্ধর্ব বিবাহ হোক, সহধর্মিণী করে নিয়ে যাও তোমার পথে।”

“বিপদের পথ হলে নিয়ে যেতুম সঙ্গে। কিন্তু যেখানে ধর্মনষ্ট হয়েছে সেখানে তোমাকে সহধর্মিণী করতে পারব না।–থাক্‌ থাক্‌ ও-সব কথা থাক্‌। এ-জীবনের নৌকোডুবির অবসানে কিছু সত্য এখনও বাকি আছে। তারই কথাটা শুনি তোমার মুখে।”

“কী বলব?”

“বলো, তুমি ভালোবেসেছ।”

“হাঁ বেসেছি।”

“বলো, আমি তোমাকে ভালোবেসেছি সে-কথা তোমার মনে থাকবে আমি যখন থাকব না তখনও।”

এলা নিরুত্তরে চুপ করে বসে রইল, জল পড়তে লাগল দুই চোখে। অনেকক্ষণ পরে বাষ্পরুদ্ধ গলায় বললে, “আবার বলছি, অন্তু, কিছু নাও আমার হাত থেকে–নাও এই আমার গলার হার।”

এই বলে পায়ের উপর রাখল হার।

“কিছুতেই না।”

“কেন, অভিমান?”

“হাঁ, অভিমান। এমন দিন ছিল তখন যদি দিতে, পরতুম গলায়–আজ দিলে পকেটে, অন্নাভাবের গর্তটার মধ্যে। ভিক্ষে নেব না তোমার কাছে।”

এলা অতীনের পায়ের কাছে লুটিয়ে বললে, “নাও আমাকে তোমার সঙ্গিনী করে।”

“লোভ দেখিয়ো না, এলা। অনেকবার বলেছি আমার পথ তোমার নয়।”

“তবে সে-পথ তোমারও নয়। ফিরে এস, ফিরে এস।”

“পথ আমার নয়, আমিই পথের। গলার ফাঁসকে গলার গয়না কেউ বলে না।”

“অন্তু, নিশ্চয় জেনো, তুমি চলে গেলে একমুহূর্ত আমি বাঁচব না। তুমি ছাড়া আর কেউ নেই আমার, এ-কথায় আজ যদি বা সন্দেহ কর, একান্ত মনে আশা করি মৃত্যুর পরে সে সন্দেহ সম্পূর্ণ ঘোচাবার একটা কোনো রাস্তা কোথাও আছে।”

হঠাৎ অতীন লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। তীরের মতো তীক্ষ্ণ হুইস্‌লের শব্দ এল দূর থেকে। চমকে বলে উঠল, “চললুম।”

এলা তাকে জড়িয়ে ধরলে, বললে, “আর-একটু থাকো।”

“না।”

“কোথায় যাচ্ছ?”

“কিচ্ছু জানি নে।”

এলা অতীনের পা জড়িয়ে ধরে বললে, “আমি তোমার সেবিকা, তোমার চরণের সেবিকা, আমাকে ফেলে যেয়ো না, ফেলে যেয়ো না।”

একটুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল অতীন। দ্বিতীয়বার হুইস্‌লের শব্দ এল। অতীন গর্জন করে বললে, “ছেড়ে দাও।” বলে নিজেকে ছিনিয়ে নিয়ে চলে গেল।

তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। এলা মেঝের উপর উপুড় হয়ে পড়ে। তার বুকের ভিতরটা শুকিয়ে গেছে, তার চোখে জল নেই। এমন সময় গম্ভীর গলায় ডাক শুনতে পেল, “এলা।”

চমকে উঠে বসল। দেখলে ইলেকট্রিক টর্চ হাতে ইন্দ্রনাথ। তখনই উঠে দাঁড়িয়ে বললে, “ফিরিয়ে আনুন অন্তুকে।”

“সে-কথা থাক্‌। এখানে কেন এলে?”

“বিপদ আছে জেনেই এসেছি।”

তীব্র ভর্ৎসনার সুরে ইন্দ্রনাথ বললেন, “তোমার বিপদের কথা কে ভাবছে? এখানকার খবর তোমাকে কে দিলে?”

“বটু।”

“তবু বুঝলে না মতলব?”

“বোঝবার বুদ্ধি আমার ছিল না। প্রাণ হাঁপিয়ে উঠেছিল।”

“তোমাকে মারতে পারলে এখনই মারতুম। যাও ঘরে ফিরে। ট্যাক্‌সি আছে বাইরে।”

চতুর্থ অধ্যায়

“আবার অখিল!–পালিয়েছিস বোডিং থেকে! তোর সঙ্গে কোনোমতে পারবার জো নেই। বারবার বলছি, এ-বাড়িতে খবরদার আসিস নে। মরবি যে।”

অখিল কোনো উত্তর না দিয়ে গলার সুর নামিয়ে বললে, “একজন দাড়িওয়ালা কে পিছনের পাঁচিল টপকিয়ে বাগানে ঢুকল। তাই তোমার এ-ঘরে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিলুম।–ওই শোনো পায়ের শব্দ।” অখিল তার ছুরির সব-চেয়ে মোটা ফলাটা খুলে দাঁড়াল।

এলা বললে, “ছুরি খুলতে হবে না তোমাকে, বীরপুরুষ। দে বলছি।” ওর হাত থেকে ছুরি কেড়ে নিলে।

সিঁড়ি থেকে আওয়াজ এল, “ভয় নেই, আমি অন্তু।”

মুহূর্তে এলার মুখ পাংশুবর্ণ হয়ে এল–বললে, “দে দরজা খুলে।”

দরজা খুলে দিয়ে অখিল জিজ্ঞাসা করলে, “সেই দাড়িওয়ালা কোথায়?”

“দাড়ি নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে বাগানে, বাকি মানুষটাকে পাবে এইখানেই। যাও খোঁজ করো গে দাড়ির।” অখিল চলে গেল।

এলা পাথরের মূর্তির মতো ক্ষণকাল একদৃষ্টে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইল। বললে, “অন্তু, এ কী চেহারা তোমার?”

অতীন বললে, “মনোহর নয়।”

“তবে কি সত্যি?”

“কী সত্যি?”

“তোমাকে সর্বনেশে ব্যামোয় ধরেছে।”

“নানা ডাক্তারের নানা মত, বিশ্বাস না করলেও চলে।”

“নিশ্চয় তোমার খাওয়া হয় নি।”

“ও কথাটা থাক্‌। সময় নষ্ট করো না।”

“কেন এলে, অন্তু, কেন এলে? এরা যে তোমাকে ধরবার অপেক্ষায় আছে।”

“ওদের নিরাশ করতে চাই নে।”

অতীনের হাত চেপে ধরে এলা বললে, “কেন এলে এই নিশ্চিত বিপদের মধ্যে। এখন উপায় কী?”

“কেন এলুম সেই কথাটা যাবার ঠিক আগেই বলে চলে যাব। ইতিমধ্যে যতক্ষণ পারি ওই কথাটাই ভুলে থাকতে চাই। নিচের দরজাগুলো বন্ধ করে দিয়ে আসি গে।”

খানিক পরে উপরে এসে বললে, “চলো ছাদে। নিচের তলাকার আলোর বাল্‌বগুলো সব খুলে নিয়েছি। ভয় পেয়ো না।”

0 Shares