চার অধ্যায়

“বলো, বলো, যা বলতে হয় বলো। দয়া করো না আমাকে। আমি নির্মম, নির্জীব, আমি মূঢ়–তোমাকে বোঝবার শক্তি আমার কোনোকালে ছিল না। অতুল্য যা তাই এসেছিল হাত বাড়িয়ে আমার কাছে, অযোগ্য আমি, মূল্য দিই নি। বহুভাগ্যের ধন চিরজন্মের মতো চলে গেল। এর চেয়ে শাস্তি যদি থাকে, দাও শাস্তি।”

“থাক্‌, থাক্‌, শাস্তির কথা। ক্ষমাই করব আমি। মৃত্যু যে ক্ষমা করে সেই অসীম ক্ষমা। সেইজন্যেই আজ এসেছি।”

“সেইজন্যে?”

“হাঁ কেবলমাত্র সেইজন্যে।”

“না-ই ক্ষমা জানাতে তুমি। কিন্তু কেন এলে এমন করে বেড়া-আগুনের মধ্যে? জানি, জানি বাঁচবার ইচ্ছে নেই তোমার। তা যদি হয় তাহলে কটা দিন কেবলমাত্র আমাকে দাও, দাও তোমার সেবা করবার শেষ অধিকার। পায়ে পড়ি তোমার।”

“কী হবে সেবা! ফুটো জীবনের ঘটে ঢালবে সুধা! তুমি জান না, কী অসহ্য ক্ষোভ আমার। শুশ্রূষা দিয়ে তার কী করতে পার, যে-মানুষ আপন সত্য হারিয়েছে!”

“সত্য হারাও নি অন্তু। সত্য তোমার অন্তরে আছে অক্ষুণ্ন হয়ে।”

“হারিয়েছি, হারিয়েছি।”

“বলো না বলো না অমন কথা।”

“আমি যে কী যদি জানতে পারতে তোমার মাথা থেকে পা পর্যন্ত শিউরে উঠত।”

“অন্তু, আত্মনিন্দা বাড়িয়ে তুলছ কল্পনায়। নিষ্কামভাবে যা করেছ তার কলঙ্ক কখনোই লাগবে না তোমার স্বভাবে।”

“স্বভাবকেই হত্যা করেছি, সব হত্যার চেয়ে পাপ। কোনো অহিতকেই সমূলে মারতে পারি নি, সমূলে মেরেছি কেবল নিজেকে। সেই পাপে, আজ তোমাকে হাতে পেলেও তোমার সঙ্গে মিলতে পারব না। পাণিগ্রহণ! এই হাত নিয়ে! কিন্তু কেন এ-সব কথা! সমস্ত কালো দাগ মুছবে যমকন্যার কালো জলে, তারই কিনারায় এসে বসেছি। আজ বলা যাক্‌ যত সব হালকা কথা হাসতে হাসতে। সেই জন্মদিনের ইতিবৃত্তটা শেষ করে দিই। কী বল, এলী?”

“অন্তু, মন দিতে পারছি নে।”

“আমাদের দুজনের জীবনে মন দেবার যোগ্য যা-কিছু আছে সে কেবল ওইরকম গোটাকয়েক হালকা দিনের মধ্যে। ভোলবার যোগ্য ভারি ভারি দিনই তো বহুবিস্তর।”

“আচ্ছা, বলো অন্তু।”

“জন্মদিনের খাওয়া হয়ে গেল। হঠাৎ নীরদের শখ হল পলাশির যুদ্ধ আবৃত্তি করবে। উঠে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে গিরিশ ঘোষের ভঙ্গিতে আউড়িয়ে গেল–

কোথা যাও ফিরে চাও সহস্র কিরণ,

বারেক ফিরিয়া চাও ওগো দিনমণি।

নীরদ লোক ভালো, অত্যন্ত সাদাসিধে, কিন্তু নির্দয় তার স্মরণশক্তি। সভাটা ভেঙে ফেলবার জন্যে আমার মন যখন হন্যে হয়ে উঠেছে তখন ওরা ভবেশকে গান গাইতে অনুরোধ করলে। ভবেশ বললে, হার্মোনিয়ম সঙ্গে না থাকলে ও হাঁ করতে পারে না। –তোমার ঘরে ওই পাপটা ছিল না। ফাঁড়া কাটল। আশান্বিত মনে ভাবছি এইবার উপসংহার, এমন সময় সতু খামকা তর্ক তুললে, মানুষ জন্মায় জন্মদিনে না জন্মতিথিতে? যত বলি থামো সে থামে না। তর্কের মধ্যে দেশাত্মবোধের ঝাঁজ লাগল, চড়তে লাগল গলার আওয়াজ, বন্ধুবিচ্ছেদ হয় আর কি। বিষম রাগ হল তোমার উপরে। আমার জন্মদিনকে একটা সামান্য উপলক্ষ্য করেছিলে, মহত্তর লক্ষ্য ছিল কর্মভাইদের একত্র করা।”

“কোন্‌টা লক্ষ্য কোন্‌টা উপলক্ষ্য বাইরে থেকে বিচার করো না অন্তু। শাস্তির যোগ্য আমি, কিন্তু অন্যায় শাস্তির না। মনে নেই তোমার, সেইবারকার জন্মদিনেই অতীন্দ্রবাবু আমার মুখে নাম নিলেন অন্তু? সেটা তো খুব ছোটো কথা নয়। তোমার অন্তু নামের ইতিহাসটা বলো শুনি।”

“সখী, তবে শ্রবণ করো। তখন বয়স আমার চার পাঁচ বছর, মাথায় ছিলুম ছোটো, কথা ছিল না মুখে, শুনেছি বোকার মতো ছিল চোখের চাহনি। জ্যেঠামশায় পশ্চিম থেকে এসে আমাকে প্রথম দেখলেন। কোলে তুলে নিলেন, বললেন, এই বালখিল্যটার নাম অতীন্দ্র রেখেছে কে? অতিশয়োক্তি অলংকার, এর নাম দাও অনতীন্দ্র। সেই অনতি শব্দটা স্নেহের কণ্ঠে অন্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তোমার কাছেও একদিন অতি হয়েছে অনতি, ইচ্ছে করে খুইয়েছে মান।”

হঠাৎ অতীন চমকে উঠে থেমে গেল। বললে, “পায়ের শব্দ শুনছি যেন।”

এলা বললে, “অখিল।”

আওয়াজ এল, “দিদিমণি।”

ছাদে আসবার দরজা খুলে দিয়ে এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী।”

অখিল বললে, “খাবার।”

বাড়িতে রান্নার ব্যবস্থা নেই। অদূরবর্তী দিশি রেস্‌টোরাঁ থেকে বরাদ্দমত খাবার দিয়ে যায়।

এলা বললে, “অন্তু, চলো খেতে।”

“খাওয়ার কথা বলো না। না খেয়ে মরতে মানুষের অনেকদিন লাগে। নইলে ভারতবর্ষ টিঁকত না। ভাই অখিল, আর রাগ রেখো না মনে। আমার ভাগটা তুমিই খেয়ে নাও। তার পরে পলায়নেন সমাপয়েৎ–দৌড় দিয়ো যত পার।”

অখিল চলে গেল।

দুজনে ছাদের মেঝের উপর বসল। অতীন আবার শুরু করলে। “সেদিনকার জন্মদিন চলতে লাগল একটানা, কেউ নড়বার নাম করে না। আমি ঘন ঘন ঘড়ি দেখছি, ওটা একটা ইঙ্গিত রাতকানাদের কাছে। শেষকালে তোমাকে বললুম, সকাল সকাল তোমার শুতে যাওয়া উচিত, এই সেদিন ইনফ্লুয়েঞ্জা থেকে উঠেছ। –প্রশ্ন উঠল, “কটা বেজেছে?’ উত্তর “সাড়ে দশটা।’ সভা ভাঙবার দুটো-একটা হাইতোলা গড়িমসি-করা লক্ষণ দেখা গেল। বটু বললে, বসে রইলেন যে অতীনবাবু? চলুন একসঙ্গে যাওয়া যাক্‌। –কোথায়? না, মেথরদের বস্‌তিতে; হঠাৎ গিয়ে পড়ে ওদের মদ খাওয়া বন্ধ করতে হবে। –সর্বশরীর জ্বলে উঠল। বললুম, মদ তো বন্ধ করবে, তার বদলে দেবে কী।–বিষয়টা নিয়ে এতটা উত্তেজিত হবার দরকার ছিল না। ফল হল, যারা চলে যাচ্ছিল তারা দাঁড়িয়ে গেল। শুরু হল–আপনি কি তবে বলতে চান–তীব্রস্বরে বলে উঠলুম–কিছু বলতে চাই নে।–এতটা বেশি ঝাঁজও বেমানান হল। গলা ভারি করে তোমার দিকে আধখানা চোখে চেয়ে বললুম, তবে আজ আসি। দোতলায় তোমার ঘরের সামনে পর্যন্ত এসে পা চলতে চায় না। কী বুদ্ধি হল বুকের পকেট চাপড়িয়ে বললুম, ফাউন্টেন পেনটা বুঝি ফেলে এসেছি। বটু বললে, আমিই খুঁজে আনছি– বলেই দ্রুত চলে গেল ছাদে। পিছু পিছু ছুটলুম আমি। খানিকটা খোঁজবার ভান করে বটু ঈষৎ হেসে বললে, দেখুন তো বোধ করি পকেটেই আছে। নিশ্চিত জানতুম আমার ফাউন্টেন পেনটা আবিষ্কার করতে হলে ভূগোল সন্ধানের প্রয়োজন আমার নিজের বাসাতেই। স্পষ্ট বলতে হল, এলাদির সঙ্গে বিশেষ কথা আছে। বটু বললে, বেশ তো অপেক্ষা করছি। আমি বললুম, অপেক্ষা করতে হবে না, যাও। বটু ঈষৎ হেসে বললে, রাগ করেন কেন অতীনবাবু, আমি চললুম।”

0 Shares