আবার পায়ের শব্দ শুনে অতীন চমকে উঠে থামল। অখিল এল ছাদে। বললে, “কে একজন এই চিরকুট দিয়েছে অতীনবাবুকে। তাকে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রেখেছি।
এলার বুক ধড়াস করে উঠল, বললে, “কে এল?”
অতীন বললে, বাবুকে ঢুকতে দাও ঘরে।” অখিল জোরের সঙ্গে বললে, “না, দেব না।”
অতীন বললে, “ভয় নেই, বাবুকে তুমি চেন; অনেকবার দেখেছ।”
“না চিনি নে।”
“খুব চেন। আমি বলছি, ভয় নেই, আমি আছি।”
এলা বললে, “অখিল, যা তুই মিথ্যে ভয় করিস নে।”
অখিল চলে গেল।
এলা জিজ্ঞাসা করলে, “বটু এসেছে না কি?”
“না বটু নয়।”
“বলো না, কে এসেছে। আমার ভালো লাগছে না।”
“থাক্ সে-কথা, যা বলছিলুম বলতে দাও।”
“অন্তু, কিছুতেই মন দিতে পারছি নে।”
“এলা, শেষ করতে দাও আমার কাহিনী। বেশি দেরি নেই।–তুমি উঠে এলে ছাদে। মৃদুগন্ধ পেলুম রজনীগন্ধার। ফুলের গুচ্ছটি সবার কাছ থেকে লুকিয়ে রেখেছিলে একলা আমার হাতে দেবে বলে। আমাদের সম্বন্ধের ক্ষেত্রে অন্তুর জীবনলীলা শুরু হল এই লাজুক ফুলের গোপন অভ্যর্থনায়, তার পর থেকে অতীন্দ্রনাথের বিদ্যাবুদ্ধি গাম্ভীর্য ক্রমে ক্রমে তলিয়ে গেল অতলস্পর্শ আত্মবিস্মৃতিতে। সেইদিন প্রথম তুমি আমার গলা জড়িয়ে ধরলে, বললে, এই নাও জন্মদিনের উপহার–সেই পেয়েছি প্রথম চুম্বন। আজ দাবি করতে এসেছি শেষ চুম্বনের।”
অখিল এসে বললে, “বাবুটি দরজায় ধাক্কা মারতে শুরু করেছে। ভাঙল বুঝি। বলছে, জরুরি কথা।”
“ভয় নেই অখিল, দরজা ভাঙবার আগেই তাকে ঠাণ্ডা করব। বাবুকে ওইখানেই অনাথ করে রেখে তুমি এখনই পালাও অন্য ঠিকানায়। আমি আছি এলাদির খবর নিতে।”
এলা অখিলকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে তার মাথায় চুমো খেয়ে বললে, “সোনা আমার, লক্ষ্ণী আমার, ভাই আমার, তুই চলে যা। তোর জন্যে কখানা নোট আমার আঁচলে বেঁধে রেখেছি, তোর এলাদির আশীর্বাদ। আমার পা ছুঁয়ে বল্, এখনই তুই যাবি, দেরি করবি নে।”
অতীন বললে, “অখিল আমার একটি পরামর্শ তোমাকে শুনতেই হবে। যদি তোমাকে কখনো কোনো প্রশ্ন কেউ জিজ্ঞাসা করে তুমি ঠিক কথাই বলবে। বলো এই রাত এগারোটার সময় আমিই তোমাকে জোর করে এ-বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছি। চলো কথাটাকে সত্য করে আসি।”
এলা আর-একবার অখিলকে কাছে টেনে নিয়ে বললে, “আমার জন্যে ভাবিস নে ভাই। তোর অন্তুদা রইল, কোনো ভয় নেই।”
অখিলকে যখন ঠেলে নিয়ে অতীন চলেছে এলা বললে,”আমিও যাই তোমার সঙ্গে অন্তু।”
আদেশের স্বরে অতীন বললে, “না, কিছুতেই না।”
ছাদের ছোটো পাঁচিলটার উপর বুক চেপে ধরে এলা দাঁড়িয়ে রইল–কণ্ঠের কাছে গুমরে গুমরে উঠতে লাগল কান্না, বুঝলে আজ রাত্রে ওর কাছ থেকে চিরকালের মতো অখিল গেল চলে।
ফিরে এল অতীন। এলা জিজ্ঞাসা করলে, “কী হল, অন্তু?”
অতীন বললে “অখিল গেছে। ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছি।”
“আর সেই লোকটি?”
“তাকেও দিয়েছি ছেড়ে। সে বসে বসে ভাবছিল কাজে ফাঁকি দিয়ে আমি বুঝি কেবল গল্পই করছি। যেন নতুন একটা আরব্য উপন্যাস শুরু হয়েছে। আরব্য উপন্যাসই বটে। সমস্তটাই গল্প, একেবারেই আজগবি গল্প। ভয় করছে এলা? আমাকে ভয় নেই তোমার?”
“তোমাকে ভয়, কী যে বল।”
“কী না করতে পারি আমি! পড়েছি পতনের শেষ সীমায়। সেদিন আমাদের দল অনাথা বিধবার সর্বস্ব লুঠ করে এনেছে। মন্মথ ছিল বুড়ীর গ্রামসম্পর্কে চেনা লোক–খবর দিয়ে পথ দেখিয়ে সে-ই এনেছে দলকে। ছদ্মবেশের মধ্যেও বিধবা তাকে চিনতে পেরে বলে উঠল, মনু, বাবা তুই এমন কাজ করতে পারলি? তার পরে বুড়ীকে আর বাঁচতে দিলে না। যাকে বলি দেশের প্রয়োজন সেই আত্মধর্মনাশের প্রয়োজনে টাকাটা এই হাত দিয়েই পৌছেছে যথাস্থানে। আমার উপবাস ভেঙেছি সেই টাকাতেই। এতদিন পরে যথার্থ দাগি হয়েছি চোরের কলঙ্কে, চোরাই মাল ছুঁয়েছি, ভোগ করেছি। চোর অতীন্দ্রের নাম বটু ফাঁস করে দিয়েছে। পাছে প্রমাণাভাবে শাস্তি না পাই বা অল্প শাস্তি পাই সেইজন্য পুলিস-সুপারিন্টেণ্ডেন্টের মারফত সে-মকদ্দমা ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে দায়ের না হয়ে যাতে বাঙালি জয়ন্ত হাজরার এজলাসে ওঠে কমিশনরের কাছ থেকে সেই হুকুম আনাবে বলে মন্ত্রণা করে রেখেছে। সে নিশ্চিত জানে, কাল ধরা পড়বই। ইতিমধ্যে ভয় করো আমাকে, আমি নিজে ভয় করি আমার মৃত আত্মার কালো ভূতটাকে। আজ তোমার ঘরে কেউ নেই।”
“কেন, তুমি আছ।”
“আমার হাত থেকে বাঁচাবে কে?”
“নেই বা বাঁচালে।”
“তোমারই আপন মণ্ডলীতে একদিন যারা ছিল এলাদির সব দেশভাই–ভাইফোঁটা দিয়েছ যাদের কপালে প্রতিবৎসর–তাদেরই মধ্যে কথা উঠেছে যে তোমার বেঁচে থাকা উচিত নয়।”
“তাদের চেয়ে বেশি অপরাধ আমি কী করেছি?”
“অনেক কথা জান তুমি, অনেকের নামধাম। পীড়ন করলে বেরিয়ে পড়বে।”
“কখনোই না।”
“কী করে বলব যে-মানুষটা এসেছিল আজ, এই হুকুম নিয়েই সে আসে নি? হুকুমের জোর কত সে তো জান তুমি।”
এলা চমকে উঠে বললে, “সত্যি বলছ অন্তু, সত্যি?”
“একটা খবর পেয়েছি আমরা।”
“কী খবর?”
“আজ ভোররাত্রে পুলিস আসবে তোমাকে ধরতে।”
“নিশ্চিত জানতুম একদিন পুলিস আমাকে ধরতে আসছে।”
“কেমন করে জানলে?”
“কাল বটুর চিঠি পেয়েছি, সে খবর দিয়েছে পুলিস আমাকে ধরবে, লিখেছে–সে এখনও আমাকে বাঁচাতে পারে।”
“কী উপায়ে?”
“বলছে, যদি তাকে বিয়ে করি তাহলে সে আমার জামিন হয়ে আমার দায় গ্রহণ করবে।”