চার অধ্যায়

“আপনি উমাকে বিয়ে করতে হুকুম করেছেন, সে তো বিয়ে করতে চায় না।”

“কে বললে চায় না?”

“সে নিজেই বলে।”

“হয়তো সে নিজে ঠিক জানে না, কিংবা নিজে ঠিক বলে না।”

“সে আপনার সামনে প্রতিজ্ঞা করেছিল বিয়ে করবে না।”

“তখন সেটা ছিল সত্য, এখন সেটা সত্য নেই। মুখের কথায় সত্য সৃষ্টি করা যায় না। প্রতিজ্ঞা উমা আপনিই ভাঙত, আমি ভাঙালুম, ওর অপরাধ বাঁচিয়ে দিলুম।”

“প্রতিজ্ঞা রাখা না-রাখার দায়িত্ব ওরই, না হয় ভাঙত, না হয় করত অপরাধ।”

“ভাঙতে ভাঙতে আশেপাশে ভাঙচুর করত বিস্তর, লোকসান হত আমাদের সকলেরই।”

“ও কিন্তু বড়ো কান্নাকাটি করছে।”

“তাহলে কান্নাকাটির দিন আর বাড়তে দেব না– কাল-পরশুর মধ্যেই বিয়ে চুকিয়ে দেওয়া যাবে।”

“কাল-পরশুর পরেও তো ওর সমস্ত জীবনটাই আছে।”

“মেয়েদের বিয়ের আগেকার কান্না প্রভাতে মেঘডম্বরং।”

“আপনি নিষ্ঠুর!”

“কেননা, মানুষকে যে-বিধাতা ভালোবাসেন তিনি নিষ্ঠুর, জন্তুকেই তিনি প্রশ্রয় দেন।”

“আপনি জানেন উমা সুকুমারকে ভালোবাসে।”

“সেইজন্যেই ওকে তফাত করতে চাই।”

“ভালোবাসার শাস্তি?”

“ভালোবাসার শাস্তির কোনো মানে নেই। তাহলে বসন্ত রোগ হয়েছে বলেও শাস্তি দিতে হয়। কিন্তু গুটি বেরোলে ঘর থেকে বের করে রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোই শ্রেয়।”

“সুকুমারের সঙ্গে বিয়ে দিলেই তো হয়।”

“সুকুমার তো কোনো অপরাধ করে নি। ওর মতো ছেলে আমাদের মধ্যে কজন আছে?”

“ও যদি নিজেই উমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়?”

“অসম্ভব নয়। সেইজন্যেই এত তাড়া। ওর মতো উঁচুদরের পুরুষের মনে বিভ্রম ঘটানো মেয়েদের পক্ষে সহজ;–সৌজন্যকে প্রশ্রয় বলে সুকুমারের কাছে প্রমাণ করা দুই-এক ফোঁটা চোখের জলেই সম্ভব হতে পারে। রাগ করছ শুনে?”

“রাগ করব কেন? মেয়েরা নিঃশব্দ নৈপুণ্যে প্রশ্রয় ঘটিয়েছে আর তার দায় মানতে হয়েছে পুরুষকে, আমার অভিজ্ঞতায় এমন ঘটনার অভাব নেই। সময় হয়েছে সত্যের অনুরোধে ন্যায়বিচার করবার। আমি সেটা করে থাকি বলেই মেয়েরা আমাকে দেখতে পারে না। যার সঙ্গে উমার বিয়ের হুকুম সেই ভোগীলালের মত কী?”

“সেই নিষ্কণ্টক ভালোমানুষের মতামত বলে কোনো উপসর্গ নেই। বাঙালির মেয়েমাত্রকেই সে বিধাতার অপূর্ব সৃষ্টি বলে জানে। ও-রকম মুগ্ধ স্বভাবের ছেলেকে দলের বাইরের আঙিনায় সরিয়ে ফেলা দরকার। জঞ্জাল ফেলার সব-চেয়ে ভালো ঝুড়ি বিবাহ।”

“এই সমস্ত উৎপাতের আশঙ্কা সত্ত্বেও আপনি মেয়ে-পুরুষকে একত্র করেছেন কেন?”

“শরীরটাতে ছাই দিয়েছে যে-সন্ন্যাসী, আর প্রবৃত্তিকে ছাই করেছে যে-ভস্মকুণ্ড সেই ক্লীবদের নিয়ে কাজ হবে না বলে। যখন দেখব আমাদের দলের কোনো অগ্নি-উপাসক অসাবধানে নিজের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ড করতে বসেছে–দেব তাদের সরিয়ে। আমাদের অগ্নিকাণ্ড দেশ জুড়ে, নেবানো মন দিয়ে তা হবে না, আর হবে না তাদের দিয়ে আগুন যারা চাপতে জানে না।”

গম্ভীর মুখে এলা বলে রইল। কিছুক্ষণ বাদে চোখ নামিয়ে বললে, “আমাকে আপনি তবে ছেড়ে দিন।”

“এতখানি ক্ষতি করতে বল কেন?”

“আপনি জানেন না।”

“জানি নে কে বললে? দেখা গেল একদিন তোমার খদ্দরে একটুখানি রঙ লেগেছে। জানা গেল অন্তরে অরুণোদয়। বুঝতে পারি একটা কোন্‌ পায়ের শব্দের প্রত্যাশায় তোমার কান পাতা থাকে। গেল শুক্রবারে যখন এলুম তোমার ঘরে, তুমি ভেবেছিলে আর-কেউ বা। দেখলুম মনটা ঠিক করে নিতে কিছু সময় লাগল। লজ্জা করো না তুমি, এতে অসংগত কিছুই নেই।”

কর্ণমূল লাল করে চুপ করে রইল এলা।

ইন্দ্রনাথ বললে, “তুমি একজনকে ভালোবেসেছ, এই তো? তোমার মন তো জড় পাষাণে গড়া নয়। যাকে ভালোবাস তাকেও জানি। অনুশোচনার কারণ কিছুই দেখছি নে।”

“আপনি বলেছিলেন একমনা হয়ে কাজ করতে হবে। সকল অবস্থায় তা সম্ভব না হতে পারে।”

“সকলের পক্ষে নয়। কিন্তু ভালোবাসার গুরুভারে তোমার ব্রত ডোবাতে পারে তুমি তেমন মেয়ে নও।”

“কিন্তু–”

“এর মধ্যে কিন্তু কিছুই নেই–তুমি কিছুতেই নিষ্কৃতি পাবে না।”

“আমি তো আপনাদের কোনো কাজে লাগি নে, সে আপনি জানেন।”

“তোমার কাছ থেকে কাজ চাই নে, কাজের কথা সব জানাইও নে তোমাকে। কেমন করে তুমি নিজে বুঝবে তোমার হাতের রক্তচন্দনের ফোঁটা ছেলেদের মনে কী আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সেটুকু বাদ দিয়ে কেবল শুখো মাইনের কাজ করতে গেলে পুরো কাজ পাব না। আমরা কামিনীকাঞ্চনত্যাগী নই। যেখানে কাঞ্চনের প্রভাব সেখানে কাঞ্চনকে অবজ্ঞা করি নে, যেখানে কামিনীর প্রভাব সেখানে কামিনীকে বেদীতে বসিয়েছি।”

“আপনার কাছে মিথ্যে বলব না, বুঝতে পারছি আমার ভালোবাসা দিনে দিনেই আমার অন্য সকল ভালোবাসাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।”

“কোনো ভয় নেই, খুব ভালোবাসো। শুধু মা মা স্বরে দেশকে যারা ডাকাডাকি করে, তারা চিরশিশু। দেশ বৃদ্ধ শিশুদের মা নয়, দেশ অর্ধনারীশ্বর–মেয়ে-পুরুষের মিলনে তার উপলব্ধি। এই মিলনকে নিস্তেজ করো না সংসার-পিঁজরেয় বেঁধে।”

“কিন্তু তবে আপনি যে ওই উমা–”

“উমা! কালু!– ভালোবাসার শুষ্ক রুদ্ররূপ ওরা সইতে পারবে কী করে? যে দাম্পত্যের ঘাটে ওদের সকল সাধনার অন্ত্যেষ্টিসৎকার, সময় থাকতে সেখানেই দুজনকে গঙ্গাযাত্রায় পাঠাচ্ছি।–সে-কথা থাক্‌। শোনা গেল তোমার ঘরে ডাকাত ঢুকেছিল পরশু রাত্রে।”

“হা, ঢুকেছিল।”

“তোমার জুজুৎসু শিক্ষায় ফল পেয়েছিলে কি?”

0 Shares