চোখের বালি

পল্লীগ্রামের প্রচলিত আতিথ্যের সহিত ইহার একটু প্রভেদ ছিল। বিহারী তাহারই উল্লেখ করিয়া প্রশংসাবাদ করিলে রাজলক্ষ্মী কহিতেন, “এই মেয়েকে কিনা তোরা অগ্রাহ্য করিলি।”

বিহারী হাসিয়া কহিত, “ভালো করি নাই মা, ঠকিয়াছি। কিন্তু বিবাহ না করিয়া ঠকা ভালো, বিবাহ করিয়া ঠকিলেই মুশকিল।”

রাজলক্ষ্মী কেবলই মনে করিতে লাগিলেন, “আহা, এই মেয়েই তো আমার বধূ হইতে পারিত। কেন হইল না।’

রাজলক্ষ্মী কলিকাতায় ফিরিবার প্রসঙ্গমাত্র উত্থাপন করিলে বিনোদিনীর চোখ ছলছল করিয়া উঠিত। সে বলিত, “পিসিমা, তুমি দুদিনের জন্যে কেন এলে! যখন তোমাকে জানিতাম না, দিন তো একরকম করিয়া কাটিত। এখন তোমাকে ছাড়িয়া কেমন করিয়া থাকিব।”

রাজলক্ষ্মী মনের আবেগে বলিয়া ফেলিতেন, “মা, তুই আমার ঘরের বউ হলি নে কেন, তা হইলে তোকে বুকের মধ্যে করিয়া রাখিতাম।”

সে কথা শুনিয়া বিনোদিনী কোনো ছুতায় লজ্জায় সেখান হইতে উঠিয়া যাইত।

রাজলক্ষ্মী কলিকাতা হইতে একটা কাতর অনুনয়পত্রের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁহার মহিন জন্মাবধি কখনো এতদিন মাকে ছাড়িয়া থাকে নাই– নিশ্চয় এতদিনে মার বিচ্ছেদ তাহাকে অধীর করিয়া তুলিতেছে। রাজলক্ষ্মী তাঁহার ছেলের অভিমান এবং আবদারের সেই চিঠিখানির জন্য তৃষিত হইয়া ছিলেন।

বিহারী মহেন্দ্রের চিঠি পাইল। মহেন্দ্র লিখিয়াছে, “মা বোধ হয় অনেক দিন পরে জন্মভূমিতে গিয়া বেশ সুখে আছেন।”

রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “আহা, মহেন্দ্র অভিমান করিয়া লিখিয়াছে। সুখে আছেন! হতভাগিনী মা নাকি মহেন্দ্রকে ছাড়িয়া কোথাও সুখে থাকিতে পারে।’

“ও বিহারী, তার পরে মহিন কী লিখিয়াছে, পড়িয়া শোনা না বাছা।”

বিহারী কহিল, “তার পরে কিছুই না মা।” বলিয়া চিঠিখানা মুঠার মধ্যে দলিত করিয়া একটা বহির মধ্যে পুরিয়া ঘরের এক কোণে ধপ করিয়া ফেলিয়া দিল।

রাজলক্ষ্মী কি আর স্থির থাকিতে পারেন। নিশ্চয়ই মহিন মার উপর এমন রাগ করিয়া লিখিয়াছে যে, বিহারী তাঁহাকে পড়িয়া শোনাইল না।

বাছুর যেমন গাভীর স্তনে আঘাত করিয়া দুগ্ধ এবং বাৎসল্যের সঞ্চার করে, মহেন্দ্রের রাগ তেমনি রাজলক্ষ্মীকে আঘাত করিয়া তাঁহার অবরুদ্ধ বাৎসল্যকে উৎসারিত করিয়া দিল। তিনি মহেন্দ্রকে ক্ষমা করিলেন। কহিলেন, “আহা, বউ লইয়া মহিন সুখে আছে, সুখে থাক্‌– যেমন করিয়া হোক সে সুখী হোক। বউকে লইয়া আমি তাহাকে আর কোনো কষ্ট দিব না। আহা, যে মা কখনো তাহাকে এক দণ্ড ছাড়িয়া থাকিতে পারে না সেই মা চলিয়া আসিয়াছে বলিয়া মহিন মার “পরে রাগ করিয়াছে!’ বার বার তাঁর চোখ দিয়া জল উছলিয়া উঠিতে লাগিল।

সেদিন রাজলক্ষ্মী বিহারীকে বার বার আসিয়া বলিলেন, “যাও বাবা, তুমি স্নান করো গে যাও। এখানে তোমার বড়ো অনিয়ম হইতেছে।”

বিহারীরও সেদিন স্নানাহারে যেন প্রবৃত্তি ছিল না; সে কহিল, “মা, আমার মতো লক্ষ্মীছাড়ারা অনিয়মেই ভালো থাকে।”

রাজলক্ষ্মী পীড়াপীড়ি করিয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি স্নান করিতে যাও।”

বিহারী সহস্র বার অনুরুদ্ধ হইয়া নাহিতে গেল। সে ঘরের বাহির হইবামাত্রই রাজলক্ষ্মী বহির ভিতর হইতে তাড়াতাড়ি সেই কুঞ্চিতদলিত চিঠিখানি বাহির করিয়া লইলেন।

বিনোদিনীর হাতে চিঠি দিয়া কহিলেন, “দেখো তো মা, মহিন বিহারীকে কী লিখিয়াছে।”

বিনোদিনী পড়িয়া শুনাইতে লাগিল। মহেন্দ্র প্রথমটা মার কথা লিখিয়াছে; কিন্তু সে অতি অল্পই, বিহারী যতটুকু শুনাইয়াছিল তাহার অধিক নহে।

তার পরেই আশার কথা। মহেন্দ্র রঙ্গে রহস্যে আনন্দে যেন মাতাল হইয়া লিখিয়াছে।

বিনোদিনী একটুখানি পড়িয়া শুনাইয়াই লজ্জিত হইয়া থামিয়া কহিল, “পিসিমা, ও আর কী শুনিবে।”

রাজলক্ষ্মীর স্নেহব্যগ্র মুখের ভাব এক মুহূর্তের মধ্যেই পাথরের মতো শক্ত হইয়া যেন জমিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী একটুখানি চুপ করিয়া রহিলেন, তার পরে বলিলেন, “থাক্‌।” বলিয়া চিঠি ফেরত না লইয়াই চলিয়া গেলেন।

বিনোদিনী সেই চিঠিখানা লইয়া ঘরে ঢুকিল। ভিতর হইতে দ্বার বন্ধ করিয়া বিছানার উপর বসিয়া পড়িতে লাগিল।

চিঠির মধ্যে বিনোদিনী কী রস পাইল, তাহা বিনোদিনীই জানে। কিন্তু তাহা কৌতুকরস নহে। বার বার করিয়া পড়িতে পড়িতে তাহার দুই চক্ষু মধ্যাহ্নের বালুকার মতো জ্বলিতে লাগিল, তাহার নিশ্বাস মরুভূমির বাতাসের মতো উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।

মহেন্দ্র কেমন, আশা কেমন, মহেন্দ্র-আশার প্রণয় কেমন, ইহাই তাহার মনের মধ্যে কেবলই পাক খাইতে লাগিল। চিঠিখানা কোলের উপর চাপিয়া ধরিয়া পা ছড়াইয়া দেয়ালের উপর হেলান দিয়া অনেকক্ষণ সম্মুখে চাহিয়া বসিয়া রহিল।

মহেন্দ্রের সে চিঠি বিহারী আর খুঁজিয়া পাইল না।

সেইদিন মধ্যাহ্নে হঠাৎ অন্নপূর্ণা আসিয়া উপস্থিত। দুঃসংবাদের আশঙ্কা করিয়া রাজলক্ষ্মীর বুকটা হঠাৎ কাঁপিয়া উঠিল– কোনো প্রশ্ন করিতে তিনি সাহস করিলেন না, অন্নপূর্ণার দিকে পাংশুবর্ণ মুখে চাহিয়া রহিলেন।

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদি, কলিকাতার খবর সব ভালো।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তবে তুমি এখানে যে?”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “দিদি, তোমার ঘরকন্নার ভার তুমি লও’সে। আমার আর সংসারে মন নাই। আমি কাশী যাইব বলিয়া যাত্রা করিয়া বাহির হইয়াছি। তাই তোমাকে প্রণাম করিতে আসিলাম। জ্ঞানে অজ্ঞানে অনেক অপরাধ করিয়াছি, মাপ করিয়ো। আর তোমার বউ, (বলিতে বলিতে চোখ ভরিয়া উঠিয়া জল পড়িতে লাগিল) সে ছেলেমানুষ, তার মা নাই, সে দোষী হোক নির্দোষ হোক সে তোমার।” আর বলিতে পারিলেন না।

0 Shares