চোখের বালি

মহেন্দ্র এইরূপে আহারে ও আচ্ছাদনে, কর্মে ও বিশ্রামে, সর্বত্রই নানা আকারে বিনোদিনীর সেবাহস্ত অনুভব করিতে লাগিল। বিনোদিনীর রচিত পশমের জুতা তাহার পায়ে এবং বিনোদিনীর বোনা পশমের গলাবন্ধ তাহার কণ্ঠদেশে একটা যেন কোমল মানসিক সংস্পর্শের মতো বেষ্টন করিল। আশা আজকাল সখিহস্তের প্রসাধনে পরিপাটি-পরিচ্ছন্ন হইয়া সুন্দরবেশে সুগন্ধ-মাখিয়া মহেন্দ্রের নিকট উপস্থিত হয়, তাহার মধ্যে যেন কতকটা আশার নিজের, কতকটা আর-একজনের– তাহার সাজসজ্জা-সৌন্দর্যে আনন্দে সে যেন গঙ্গাযমুনার মতো তাহার সখীর সঙ্গে মিলিয়া গেছে।

বিহারীর আজকাল পূর্বের মতো আদর নাই– তাহার ডাক পড়ে না। বিহারী মহেন্দ্রকে লিখিয়া পাঠাইয়াছিল, কাল রবিবার আছে, দুপুরবেলা আসিয়া সে মহেন্দ্রের মার রান্না খাইবে। মহেন্দ্র দেখিল রবিবারটা নিতান্ত মাটি হয়, তাড়াতাড়ি লিখিয়া পাঠাইল, রবিবারে বিশেষ কাজে তাহাকে বাহিরে যাইতে হইবে।

তবু বিহারী আহারান্তে একবার মহেন্দ্রের বাড়ির খোঁজ লইতে আসিল। বেহারার কাছে শুনিল, মহেন্দ্র বাড়ি হইতে বাহিরে যায় নাই। “মহিনদা” বলিয়া সিঁড়ি হইতে হাঁকিয়া বিহারী মহেন্দ্রের ঘরে গেল। মহেন্দ্র অপ্রস্তুত হইয়া কহিল,”ভারি মাথা ধরিয়াছে।” বলিয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া পড়িল। আশা সে কথা শুনিয়া এবং মহেন্দ্রের মুখের ভাব দেখিয়া শশব্যস্ত হইয়া উঠিল– কী করা কর্তব্য, স্থির করিবার জন্য বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। বিনোদিনী বেশ জানিত ব্যাপারটা গুরুতর নহে, তবু অত্যন্ত উদ্‌বিগ্নভাবে কহিল, “অনেকক্ষণ বসিয়া আছ, একটুখানি শোও। আমি ওডিকলোন আনিয়া দিই।”

মহেন্দ্র বলিল, “থাক্‌, দরকার নাই।”

বিনোদিনী শুনিল না, দ্রুতপদে ওডিকলোন বরফজলে মিশাইয়া উপস্থিত করিল। আশার হাতে ভিজা রুমাল দিয়া কহিল, “মহেন্দ্রবাবুর মাথায় বাঁধিয়া দাও।”

মহেন্দ্র বারবার বলিতে লাগিল, “থাক্‌-না।” বিহারী অবরুদ্ধহাস্যে নীরবে অভিনয় দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্র সগর্বে ভাবিল, “বিহারীটা দেখুক, আমার কত আদর।’

আশা বিহারীর সম্মুখে লজ্জাকম্পিত হস্তে ভালো করিয়া বাঁধিতে পারিল না– ফোঁটাখানেক ওডিকলোন গড়াইয়া মহেন্দ্রের চোখে পড়িল। বিনোদিনী আশার হাত হইতে রুমাল লইয়া সুনিপুণ করিয়া বাঁধিল এবং আর-একটি বস্ত্রখণ্ডে ওডিকলোন ভিজাইয়া অল্প অল্প করিয়া নিংড়াইয়া দিল– আশা মাথায় ঘোমটা টানিয়া পাখা করিতে লাগিল।

বিনোদিনী স্নিগ্ধস্বরে জিজ্ঞাসা করিল, “মহেন্দ্রবাবু, আরাম পাচ্ছেন কি।”

এইরূপে কণ্ঠস্বরে মধু ঢালিয়া দিয়া বিনোদিনী দ্রুতকটাক্ষে একবার বিহারীর মুখের দিকে চাহিয়া লইল। দেখিল, বিহারীর চক্ষু কৌতুকে হাসিতেছে। সমস্ত ব্যাপারটা তাহার কাছে প্রহসন। বিনোদিনী বুঝিয়া লইল, এ লোকটিকে ভোলানো সহজ ব্যাপার নহে– কিছুই ইহার নজর এড়ায় না।

বিহারী হাসিয়া কহিল, “বিনোদ-বোঠান, এমনতরো শুশ্রুষা পাইলে রোগ সারিবে না, বাড়িয়া যাইবে।”

বিনোদিনী। তা কেমন করিয়া জানিব, আমরা মূর্খ মেয়েমানুষ। আপনাদের ডাক্তারিশাস্ত্রে বুঝি এইমতো লেখা আছে।

বিহারী। আছেই তো। সেবা দেখিয়া আমারও কপাল ধরিয়া উঠিতেছে। কিন্তু পোড়াকপালকে বিনা-চিকিৎসাতেই চটপট সারিয়া উঠিতে হয়। মহিনদার কপালের জোর বেশি।

বিনোদিনী ভিজা বস্ত্রখণ্ড রাখিয়া দিয়া কহিল, “কাজ নাই, বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুতেই করুন।”

বিহারী সমস্ত ব্যাপার দেখিয়া ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। এ কয়দিন সে অধ্যয়নে ব্যস্ত ছিল, ইতিমধ্যে মহেন্দ্র বিনোদিনী ও আশায় মিলিয়া আপনা আপনি যে এতখানি তাল পাকাইয়া তুলিয়াছে তাহা সে জানিত না। আজ সে বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়া দেখিল, বিনোদিনীও তাহাকে দেখিয়া লইল।

বিহারী কিছু তীক্ষ্ণস্বরে কহিল, “ঠিক কথা। বন্ধুর চিকিৎসা বন্ধুই করিবে। আমিই মাথাধরা আনিয়াছিলাম, আমি তাহা সঙ্গে লইয়া চলিলাম। ওডিকলোন আর বাজে খরচ করিবেন না।” আশার দিকে চাহিয়া কহিল, “বোঠান, চিকিৎসা করিয়া রোগ সারানোর চেয়ে রোগ না হইতে দেওয়াই ভালো।”

১৬

বিহারী ভাবিল, “আর দূরে থাকিলে চলিবে না, যেমন করিয়া হউক, ইহাদের মাঝখানে আমাকেও একটা স্থান লইতে হইবে। ইহাদের কেহই আমাকে চাহিবে না, তবু আমাকে থাকিতে হইবে।’

বিহারী আহ্বান-অভ্যর্থনার অপেক্ষা না রাখিয়াই মহেন্দ্রের ব্যুহের মধ্যে প্রবেশ করিতে লাগিল। বিনোদিনীকে কহিল, “বিনোদ-বোঠান, এই ছেলেটিকে ইহার মা মাটি করিয়াছে, বন্ধু মাটি করিয়াছে, স্ত্রী মাটি করিতেছে– তুমিও সেই দলে না ভিড়িয়া একটা নূতন পথ দেখাও– দোহাই তোমার।”

মহেন্দ্র। অর্থাৎ–

বিহারী। অর্থাৎ আমার মতো লোক, যাহাকে কেহ কোনোকালে পোঁছে না–

মহেন্দ্র। তাহাকে মাটি করো। মাটি হইবার উমেদারি সহজ নয় হে বিহারী, দরখাস্ত পেশ করিলেই হয় না।

বিনোদিনী হাসিয়া কহিল, “মাটি হইবার ক্ষমতা থাকা চাই, বিহারীবাবু।”

বিহারী কহিল, “নিজগুণ না থাকিলেও হাতের গুণে হইতে পারে। একবার প্রশ্রয় দিয়া দেখোই-না।”

বিনোদিনী। আগে হইতে প্রস্তুত হইয়া আসিলে কিছু হয় না, অসাবধান থাকিতে হয়। কী বল, ভাই চোখের বালি। তোমার এই দেওরের ভার তুমিই লও-না, ভাই।

0 Shares