চোখের বালি

আশার কান্নার কথা শুনিয়া হঠাৎ মহেন্দ্রের মন একটা প্রতিঘাত পাইল। জগতে আর যে কাহারো সুখদুঃখ আছে, সে কথা তাহার নূতন নেশার কাছে স্থান পায় নাই। হঠাৎ চমক লাগিল, জিজ্ঞাসা করিল, “আশা কাঁদিতেছে কী জন্য।”

বিহারী বিরক্ত হইয়া কহিল, “সে কথা তুমি জান না, আমি জানি?”

মহেন্দ্র। তোমার মহিনদা সর্বজ্ঞ নয় বলিয়া যদি রাগ করিতেই হয় তো মহিনদার সৃষ্টিকর্তার উপর রাগ করো।

তখন বিহারী যাহা দেখিয়াছিল, তাহা আগাগোড়া বলিল। বলিতে বলিতে বিনোদিনীর বক্ষোলগ্ন আশার সেই অশ্রুসিক্ত মুখখানি মনে পড়িয়া বিহারীর প্রায় কণ্ঠরোধ হইয়া আসিল।

বিহারীর এই প্রবল আবেগ দেখিয়া মহেন্দ্র আশ্চর্য হইয়া গেল। মহেন্দ্র জানিত বিহারীর হৃদয়ের বালাই নাই — এ উপসর্গ কবে জুটিল। যেদিন কুমারী আশাকে দেখিতে গিয়াছিল, সেই দিন হইতে নাকি। বেচারা বিহারী। মহেন্দ্র মনে মনে তাহাকে বেচারা বলিল বটে, কিন্তু দুঃখবোধ না করিয়া বরঞ্চ একটু আমোদ পাইল। আশার মনটি একান্তভাবে যে কোন্‌ দিকে, তাহা মহেন্দ্র নিশ্চয় জানিত। “অন্য লোকের কাছে যাহারা বাঞ্ছার ধন, কিন্তু আয়ত্তের অতীত, আমার কাছে তাহারা চিরদিনের জন্য আপনি ধরা দিয়াছে,’ ইহাতে মহেন্দ্র বক্ষের মধ্যে একটা গর্বের স্ফীতি অনুভব করিল।

মহেন্দ্র বিহারীকে কহিল, “আচ্ছা চলো, যাওয়া যাক। তবে একটা গাড়ি ডাকো।”

২২

মহেন্দ্র ঘরে ফিরিয়া আসিবামাত্র তাহার মুখ দেখিয়াই আশার মনের সমস্ত সংশয় ক্ষণকালের কুয়াশার মতো এক মুহূর্তেই কাটিয়া গেল। নিজের চিঠির কথা স্মরণ করিয়া লজ্জায় মহেন্দ্রের সামনে সে যেন মুখ তুলিতেই পারিল না। মহেন্দ্র তাহার উপরে ভর্ৎসনা করিয়া কহিল, “এমন অপবাদ দিয়া চিঠিগুলা লিখিলে কী করিয়া।”

বলিয়া পকেট হইতে বহুবার পঠিত সেই চিঠি তিনখানি বাহির করিল। আশা ব্যাকুল হইয়া কহিল, “তোমার পায়ে পড়ি, ও চিঠিগুলো ছিঁড়িয়া ফেলো।” বলিয়া মহেন্দ্রের হাত হইতে চিঠিগুলা লইবার জন্য ব্যস্ত হইয়া পড়িল। মহেন্দ্র তাহাকে নিরস্ত করিয়া সেগুলি পকেটে পুরিল। কহিল, “আমি কর্তব্যের অনুরোধে গেলাম, আর তুমি আমার অভিপ্রায় বুঝিলে না? আমাকে সন্দেহ করিলে?”

আশা ছল-ছল চোখে কহিল, “এবারকার মতো আমাকে মাপ করো। এমন আর কখনোই হইবে না।”

মহেন্দ্র কহিল, “কখনো না?”

আশা কহিল, “কখনো না।”

তখন মহেন্দ্র তাহাকে টানিয়া লইয়া চুম্বন করিল। আশা কহিল, “চিঠিগুলা দাও, ছিঁড়িয়া ফেলি।”

মহেন্দ্র কহিল, “না, ও থাক্‌!”

আশা সবিনয়ে মনে করিল, “আমার শাস্তিস্বরূপ এ চিঠিগুলি উনি রাখিলেন।’

এই চিঠির ব্যাপারে বিনোদিনীর উপর আশার মনটা একটু যেন বাঁকিয়া দাঁড়াইল। স্বামীর আগমনবার্তা লইয়া সে সখীর কাছে আনন্দ করিতে গেল না– বরঞ্চ বিনোদিনীকে একটু যেন এড়াইয়া গেল। বিনোদিনী সেটুকু লক্ষ্য করিল এবং কাজের ছল করিয়া একেবারে দূরে রহিল।

মহেন্দ্র ভাবিল, “এ তো বড়ো অদ্ভুত। আমি ভাবিয়াছিলাম, এবার বিনোদিনীকে বিশেষ করিয়াই দেখা যাইবে– উল্‌টা হইল? তবে সে চিঠিগুলার অর্থ কী।’

নারীহৃদয়ের রহস্য বুঝিবার কোনো চেষ্টা করিবে না বলিয়াই মহেন্দ্র মনকে দৃঢ় করিয়াছিল– ভাবিয়াছিল, বিনোদিনী যদি কাছে আসিবার চেষ্টা করে, তবু আমি দূরে থাকিব।’ আজ সে মনে মনে কহিল, “না, এ তো ঠিক হইতেছে না। যেন আমাদের মধ্যে সত্যই কী একটা বিকার ঘটিয়াছে। বিনোদিনীর সঙ্গে সহজ স্বাভাবিক ভাবে কথাবার্তা আমোদপ্রমোদ করিয়া এই সংশয়াচ্ছন্ন গুমোটের ভাবটা দূর করিয়া দেওয়া উচিত।’

আশাকে মহেন্দ্র কহিল, “দেখিতেছি, আমিই তোমার সখীর চোখের বালি হইলাম। আজকাল তাঁহার আর দেখাই পাওয়া যায় না।”

আশা উদাসীন ভাবে উত্তর করিল, “কে জানে, তাহার কী হইয়াছে।”

এ দিকে রাজলক্ষ্মী আসিয়া কাঁদো-কাঁদো হইয়া কহিলেন, “বিপিনের বউকে আর তো ধরিয়া রাখা যায় না।”

মহেন্দ্র চকিত ভাব সামলাইয়া কহিল, “কেন, মা।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কি জানি বাছা, সে তো এবার বাড়ি যাইবার জন্য নিতান্তই ধরিয়া পড়িয়াছে। তুই তো কাহাকেও খাতির করিতে জানিস না। ভদ্রলোকের মেয়ে পরের বাড়িতে আছে, উহাকে আপনার লোকের মতো আদর-যত্ন না করিলে থাকিবে কেন।”

বিনোদিনী শোবার ঘরে বসিয়া বিছানার চাদর সেলাই করিতেছিল। মহেন্দ্র প্রবেশ করিয়া ডাকিল, “বালি।”

বিনোদিনী সংযত হইয়া বসিল। কহিল, “কী, মহেন্দ্রবাবু।”

মহেন্দ্র কহিল, “কী সর্বনাশ। মহেন্দ্র আবার বাবু হইলেন কবে।”

বিনোদিনী আবার চাদর সেলাইয়ের দিকে নতচক্ষু নিবদ্ধ রাখিয়া কহিল, “তবে কী বলিয়া ডাকিব।”

মহেন্দ্র কহিল, “তোমার সখীকে যা বল– চোখের বালি।”

বিনোদিনী অন্যদিনের মতো ঠাট্টা করিয়া তাহার কোনো উত্তর দিল না– সেলাই করিয়া যাইতে লাগিল।

মহেন্দ্র কহিল, “ওটা বুঝি সত্যকার সম্বন্ধ হইল, তাই ওটা আর পাতানো চলিতেছে না!”

বিনোদিনী একটু থামিয়া দাঁত দিয়া সেলাইয়ের প্রান্ত হইতে খানিকটা বাড়তি সুতা কাটিয়া ফেলিয়া কহিল, “কী জানি, সে আপনি জানেন।”

বলিয়াই তাহার সর্বপ্রকার উত্তর চাপা দিয়া গম্ভীরমুখে কহিল, “কালেজ হইতে হঠাৎ ফেরা হইল যে?”

মহেন্দ্র কহিল, “কেবল মড়া কাটিয়া আর কত দিন চলিবে।”

আবার বিনোদিনী দন্ত দিয়া সুতা ছেদন করিল এবং মুখ না তুলিয়াই কহিল, “এখন বুঝি জিয়ন্তের আবশ্যক।”

0 Shares