চোখের বালি

২৯

পরদিন ঘুম ভাঙিয়া বিছানা হইতে উঠিবামাত্রই একটি মধুর আবেগে মহেন্দ্রের হৃদয় পূর্ণ হইয়া গেল। প্রভাতের সূর্যালোক যেন তাহার সমস্ত ভাবনায় বাসনায় সোনা মাখাইয়া দিল। কী সুন্দর পৃথিবী, কী মধুময় আকাশ, বাতাস যেন পুষ্পরেণুর মতো সমস্ত মনকে উড়াইয়া লইয়া যাইতেছে।

সকালবেলায় বৈষ্ণব ভিক্ষুক খোল-করতাল বাজাইয়া গান জুড়িয়া দিয়াছিল। দরোয়ান তাড়াইয়া দিতে উদ্যত হইলে মহেন্দ্র দরোয়ানকে ভর্ৎসনা করিয়া তখনই তাহাদিগকে একটা টাকা দিয়া ফেলিল। বেহারা কেরোসিনের ল্যাম্প লইয়া যাইবার সময় অসাবধানে ফেলিয়া দিয়া চুরমার করিল– মহেন্দ্রের মুখের দিকে তাকাইয়া ভয়ে তাহার প্রাণ শুকাইয়া গেল। মহেন্দ্র তিরস্কারমাত্র না করিয়া প্রসন্নমুখে কহিল,”ওরে ওখানটা ভালো করিয়া ঝাঁট দিয়া ফেলিস– যেন কাহারো পায়ে কাঁচ না ফোটে।”

আজ কোনো ক্ষতিকেই ক্ষতি বলিয়া মনে হইল না।

প্রেম এতদিন নেপথ্যের আড়ালে লুকাইয়া বসিয়া ছিল– আজ যে সন্মুখে আসিয়া পর্দা উঠাইয়া দিয়াছে। জগৎসংসারের উপর হইতে আবরণ উঠিয়া গেছে। প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত তুচ্ছতা আজ অন্তর্হিত হইল। গাছপালা, পশুপক্ষী, পথের জনতা, নগরের কোলাহল, সকলই আজ অপরূপ। এই বিশ্বব্যাপী নূতনতা এতকাল ছিল কোথায়।

মহেন্দ্রের মনে হইতে লাগিল, আজ যেন বিনোদিনীর সঙ্গে অন্যদিনের মতো সামান্যভাবে মিলন হইবে না। আজ যেন কবিতায় কথা বলিলে এবং সংগীতে ভাব প্রকাশ করিলে, তবে ঠিক উপযুক্ত হয়। আজিকার দিনকে ঐশ্বর্যে সৌন্দর্যে পূর্ণ করিয়া মহেন্দ্র সৃষ্টিছাড়া সমাজছাড়া একটা আরব্য-উপন্যাসের অদ্ভুত দিনের মতো করিয়া তুলিতে চায়। তাহা সত্য হইবে, অথচ স্বপ্ন হইবে–তাহাতে সংসারের কোনো বিধিবিধান, কোনো দায়িত্ব, কোনো বাস্তবিকতা থাকিবে না।

আজ সকাল হইতে মহেন্দ্র চঞ্চল হইয়া বেড়াইতে লাগিল, কালেজে যাইতে পারিল না; কারণ, মিলনের লগ্নটি কখন অকস্মাৎ আবির্ভূত হইবে, তাহা তো কোনো পঞ্জিকায় লেখে না।

গৃহকার্যে রত বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর মাঝে মাঝে ভাঁড়ার হইতে, রান্নাঘর হইতে মহেন্দ্রের কানে আসিয়া পৌঁছিতে লাগিল। আজ তাহা মহেন্দ্রের ভালো লাগিল না– আজ সে বিনোদিনীকে মনে মনে সংসার হইতে বহুদূরে স্থাপন করিয়াছে।

সময় কাটিতে চায় না। মহেন্দ্রের স্নানাহার হইয়া গেল– সমস্ত গৃহকর্মের বিরামে মধ্যাহ্ন নিস্তব্ধ হইয়া আসিল। তবু বিনোদিনীর দেখা নাই। দুঃখে এবং সুখে, অধৈর্যে এবং আশায় মহেন্দ্রের মনোযন্ত্রের সমস্ত তারগুলা ঝংকৃত হইতে লাগিল।

কালিকার কাড়াকাড়ি-করা সেই বিষবৃক্ষখানি নীচের বিছানায় পড়িয়া আছে। দেখিবামাত্র সেই কাড়াকাড়ির স্মৃতিতে মহেন্দ্রের মনে পুলকাবেশ জাগিয়া উঠিল। বিনোদিনী যে-বালিশ চাপিয়া শুইয়াছিল, সেই বালিশটা টানিয়া লইয়া মহেন্দ্র তাহাতে মাথা রাখিল; এবং বিষবৃক্ষখানি তুলিয়া লইয়া তাহার পাতা উলটাইতে লাগিল। ক্রমে কখন এক সময় পড়ায় মন লাগিয়া গেল, কখনা পাঁচটা বাজিয়া গেল–হুঁশ হইল না।

এমন সময় একটি মোরাদাবাদি খুঞ্চের উপর থালায় ফল ও সন্দেশ এবং রেকাবে বরফচিনিসংযুক্ত সুগন্ধি দলিত খরমুজা লইয়া বিনোদিনী ঘরে প্রবেশ করিল এবং মহেন্দ্রের সম্মুখে রাখিয়া কহিল, “কী করিতেছ, ঠাকুরপো। তোমার হইল কী। পাঁচটা বাজিয়া গেছে, এখনো হাতমুখ-ধোয়া কাপড়-ছাড়া হইল না?”

মহেন্দ্রের মনে একটা ধাক্কা লাগিল। মহেন্দ্রের কী হইয়াছে, সে কি জিজ্ঞাসা করিবার বিষয়। বিনোদিনীর সে কি অগোচর থাকা উচিত। আজিকার দিন কি অন্য দিনেরই মতো। পাছে যাহা আশা করিয়াছিল, হঠাৎ তাহার উলটা কিছু দেখিতে পায়, এই ভয়ে মহেন্দ্র গতকল্যকার কথা স্মরণ করাইয়া কোনো দাবি উত্থাপন করিতে পারিল না।

মহেন্দ্র খাইতে বসিল। বিনোদিনী ছাদে-বিছানো রৌদ্রে-দেওয়া মহেন্দ্রের কাপড়গুলি দ্রুতপদে ঘরে বহিয়া আনিয়া নিপুণ হস্তে ভাঁজ করিয়া কাপড়ের আলমারির মধ্যে তুলিতে লাগিল।

মহেন্দ্র কহিল, “একটু রোসো, আমি খাইয়া উঠিয়া তোমার সাহায্য করিতেছি।”

বিনোদিনী জোড়হাত করিয়া কহিল, “দোহাই তোমার, আর যা কর সাহায্য করিয়ো না।”

মহেন্দ্র খাইয়া উঠিয়া কহিল, “বটে! আমাকে অকর্মণ্য ঠাওরাইয়াছ! আচ্ছা, আজ আমার পরীক্ষা হউক!” বলিয়া কাপড় ভাঁজ করিবার বৃথা চেষ্টা করিতে লাগিল।

বিনোদিনী মহেন্দ্রের হাত হইতে কাপড় কাড়িয়া লইয়া কহিল, “ওগো মশায়, তুমি রাখো, আমার কাজ বাড়াইয়ো না।”

মহেন্দ্র কহিল, “তবে তুমি কাজ করিয়া যাও, আমি দেখিয়া শিক্ষালাভ করি।” বলিয়া আলমারির সম্মুখে বিনোদিনীর কাছে আসিয়া মাটিতে আসন করিয়া বসিল। বিনোদিনী কাপড় ঝাড়িবার ছলে একবার করিয়া মহেন্দ্রের পিঠের উপর আছড়াইয়া কাপড়গুলি পরিপাটিপূর্বক ভাঁজ করিয়া আলমারিতে তুলিতে লাগিল।

আজিকার মিলন এমনি করিয়া আরম্ভ হইল। মহেন্দ্র প্রত্যুষ হইতে যেরূপ কল্পনা করিতেছিল, সেই অপূর্বতার কোনো লক্ষণই নাই। এরূপভাবে মিলন কাব্যে লিখিবার, সংগীতে গাহিবার, উপন্যাসে রচিবার যোগ্য নহে। কিন্তু তবু মহেন্দ্র দুঃখিত হইল না, বরঞ্চ একটু আরাম পাইল। তাহার কাল্পনিক আদর্শকে কেমন করিয়া খাড়া করিয়া রাখিত, কিরূপ তাহার আয়োজন, কী কথা বলিত, কী ভাব প্রকাশ করিতে হইত, সকলপ্রকার সামান্যতাকে কী উপায়ে দূরে রাখিত, তাহা মহেন্দ্র ঠাওরাইতে পারিতেছিল না–এই কাপড় ঝাড়া ও ভাঁজ করার মধ্যে হাসিতামাশা করিয়া সে যেন স্বরচিত একটা অসম্ভব দুরূহ আদর্শের হাত হইতে নিষ্কৃতি পাইয়া বাঁচিল।

0 Shares