চোখের বালি

এমন সময় রাজলক্ষ্মী ঘরে প্রবেশ করিলেন। মহেন্দ্রকে কহিলেন, “মহিন, বউ কাপড় তুলিতেছে, তুই ওখানে বসিয়া কী করিতেছিস।”

বিনোদিনী কহিল, “দেখো তো পিসিমা মিছামিছি কেবল আমার কাজে দেরি করাইয়া দিতেছেন।”

মহেন্দ্র কহিল, “বিলক্ষণ। আমি আরো ওঁর কাজে সাহায্য করিতেছিলাম।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “আমার কপাল! তুই আবার সাহায্য করিবি! জান বউ, মহিনের বরাবর ঐরকম। চিরকাল মা-খুড়ির আদর পাইয়া ও যদি কোনো কাজ নিজের হাতে করিতে পারে।”

এই বলিয়া মাতা পরমস্নেহে কর্মে অপটু মহেন্দ্রের প্রতি নেত্রপাত করিলেন। কেমন করিয়া এই অকর্মণ্য একান্ত মাতৃস্নেহাপেক্ষী বয়স্ক সন্তানটিকে সর্বপ্রকার আরামে রাখিতে পারিবেন, বিনোদিনীর সহিত রাজলক্ষ্মীর সেই একমাত্র পরামর্শ। এই পুত্রসেবাব্যাপারে বিনোদিনীর প্রতি নির্ভর করিয়া তিনি নিতান্ত নিশ্চিন্ত, পরম সুখী। সম্প্রতি বিনোদিনীর মর্যাদা যে মহেন্দ্র বুঝিয়াছে এবং বিনোদিনীকে রাখিবার জন্য তাহার যত্ন হইয়াছে, ইহাতেও রাজলক্ষ্মী আনন্দিত। মহেন্দ্রকে শুনাইয়া শুনাইয়া তিনি কহিলেন, “বউ, আজ তো তুমি মহিনের গরম কাপড় রোদে দিয়া তুলিলে, কাল মহিনের নূতন রুমালগুলিতে উহার নামের অক্ষর সেলাই করিয়া দিতে হইবে। তোমাকে এখানে আনিয়া অবধি যত্ন-আদর করিতে পারিলাম না বাছা, কেবল খাটাইয়া মারিলাম।”

বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, অমন করিয়া যদি বল তবে বুঝিব তুমি আমাকে পর ভাবিতেছ।”

রাজলক্ষ্মী আদর করিয়া কহিলেন, “আহা মা, তোমার মতো আপন আমি পাব কোথায়।”

বিনোদিনীর কাপড়-তোলা শেষ হইলে রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “এখন কি তবে সেই চিনির রসটা চড়াইয়া দিব, না, এখন তোমার অন্য কাজ আছে?”

বিনোদিনী কহিল, “না, পিসিমা, অন্য কাজ আর কই। চলো মিঠাইগুলি তৈরি করিয়া আসি গে।”

মহেন্দ্র কহিল, “মা, এইমাত্র অনুতাপ করিতেছিলে উহাকে খাটাইয়া মারিতেছ, আবার এখনই কাজে টানিয়া লইয়া চলিলে?”

রাজলক্ষ্মী বিনোদিনীর চিবুক স্পর্শ করিয়া কহিলেন, “আমাদের লক্ষ্মী মেয়ে যে কাজ করিতেই ভালোবাসে।”

মহেন্দ্র কহিল, “আজ সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে কোনো কাজ নাই, ভাবিয়াছিলাম বালিকে লইয়া একটা বই পড়িব।”

বিনোদিনী কহিল, “পিসিমা, বেশ তো, আজ সন্ধ্যাবেলা আমরা দুজনেই ঠাকুরপোর বই-পড়া শুনিতে আসিব–কী বল।”

রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, “মহিন আমার নিতান্ত একলা পড়িয়াছে, এখন সকলে মিলিয়া তাহাকে ভুলাইয়া রাখা আবশ্যক।” কহিলেন, “তা বেশ তো, মহিনের খাবার তৈরি শেষ করিয়া আমরা আজ সন্ধ্যাবেলা পড়া শুনিতে আসিব। কী বলিস, মহিন।”

বিনোদিনী মহেন্দ্রের মুখের দিকে কটাক্ষপাত করিয়া একবার দেখিয়া লইল। মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা।” কিন্তু তাহার আর উৎসাহ রহিল না। বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর সঙ্গে-সঙ্গেই বাহির হইয়া গেল।

মহেন্দ্র রাগ করিয়া ভাবিল, “আমিও আজ বাহির হইয়া যাইব–দেরি করিয়া বাড়ি ফিরিব।’ বলিয়া তখনই বাহিরে যাইবার কাপড় পরিল। কিন্তু সংকল্প কাজে পরিণত হইল না। মহেন্দ্র অনেকক্ষণ ধরিয়া ছাদে পায়চারি করিয়া বেড়াইল, সিঁড়ির দিকে অনেক বার চাহিল, শেষে ঘরের মধ্যে আসিয়া বসিয়া পড়িল। বিরক্ত হইয়া মনে মনে কহিল, “আমি আজ মিঠাই স্পর্শ না করিয়া মাকে জানাইয়া দিব, এত দীর্ঘকাল ধরিয়া চিনির রস জ্বাল দিলে তাহাতে মিষ্টত্ব থাকে না।’

আজ আহারের সময় বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীকে সঙ্গে করিয়া আনিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানির ভয়ে প্রায় উপরে উঠিতে চান না, বিনোদিনী তাঁহাকে অনুরোধ করিয়াই সঙ্গে আনিয়াছে। মহেন্দ্র অত্যন্ত গম্ভীর মুখে খাইতে বসিল।

বিনোদিনী কহিল, “ও কী ঠাকুরপো, আজ তুমি কিছুই খাইতেছ না যে!”

রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কিছু অসুখ করে নাই তো?”

বিনোদিনী কহিল, “এত করিয়া মিঠাই করিলাম, কিছু মুখে দিতেই হইবে। ভালো হয় নি বুঝি? তবে থাক্‌। না না, অনুরোধে পড়িয়া জোর করিয়া খাওয়া কিছু নয়। না না, কাজ নাই।”

মহেন্দ্র কহিল, “ভালো মুশকিলেই ফেলিলে। মিঠাইটাই সব চেয়ে খাইবার ইচ্ছা, লাগিতেছেও ভালো, তুমি বাধা দিলে শুনিব কেন।”

দুইটি মিঠাই মহেন্দ্র নিঃশেষপূর্বক খাইল–তাহার একটি দানা, একটু গুঁড়া পর্যন্ত ফেলিল না।

আহারান্তে তিন জনে মহেন্দ্রের শোবার ঘরে আসিয়া বসিলেন। পড়িবার প্রস্তাবটা মহেন্দ্র আর তুলিল না। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “তুই কী বই পড়িবি বলিয়াছিলি, আরম্ভ কর-না।”

মহেন্দ্র কহিল, “কিন্তু তাহাতে ঠাকুর-দেবতার কথা কিছুই নাই, তোমার শুনিতে ভালো লাগিবে না।”

ভালো লাগিবে না! যেমন করিয়া হোক, ভালো লাগিবার জন্য রাজলক্ষ্মী কৃতসংকল্প। মহেন্দ্র যদি তুর্কি ভাষাও পড়ে, তাঁহার ভালো লাগিতেই হইবে। আহা বেচারা মহিন, বউ কাশী গেছে, একলা পড়িয়া আছে–তাহার যা ভালো লাগিবে মাতার তাহার ভালো না লাগিলে চলিবে কেন।

বিনোদিনী কহিল, “এক কাজ করো-না ঠাকুরপো, পিসিমার ঘরে বাংলা শান্তিশতক আছে, অন্য বই রাখিয়া আজ সেইটে পড়িয়া শোনাও-না। পিসিমারও ভালো লাগিবে, সন্ধ্যাটাও কাটিবে ভালো।”

মহেন্দ্র নিতান্ত করুণভাবে একবার বিনোদিনীর মুখের দিকে চাহিল। এমন সময় ঝি আসিয়া খবর দিল, “মা, কায়েত-ঠাকরুন আসিয়া তোমার ঘরে বসিয়া আছেন।”

0 Shares