চোখের বালি

কায়েত-ঠাকরুন রাজলক্ষ্মীর অন্তরঙ্গ বন্ধু। সন্ধ্যার পর তাঁহার সঙ্গে গল্প করিবার প্রলোভন সংবরণ করা রাজলক্ষ্মীর পক্ষে দুঃসাধ্য। তবু ঝিকে বলিলেন, “কায়েত-ঠাকরুনকে বল্‌, আজ মহিনের ঘরে আমার একটু কাজ আছে, কাল তিনি যেন অবশ্য-অবশ্য করিয়া আসেন।”

মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি কহিল, “কেন মা, তুমি তাঁর সঙ্গে দেখা করিয়াই এসো-না।”

বিনোদিনী কহিল, “কাজ কী পিসিমা, তুমি এখানে থাকো, আমি বরঞ্চ কায়েত-ঠাকরুনের কাছে গিয়া বসি গে।”

রাজলক্ষ্মী প্রলোভন সংবরণ করিতে না পারিয়া কহিলেন, “বউ, তুমি ততক্ষণ এখানে বোসো–দেখি, যদি কায়েত-ঠাকরুনকে বিদায় করিয়া আসিতে পারি। তোমারা পড়া আরম্ভ করিয়া দাও–আমার জন্য অপেক্ষা করিয়ো না।”

রাজলক্ষ্মী ঘরের বাহির হইবামাত্র মহেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না–বলিয়া উটিল, “কেন তুমি আমাকে ইচ্ছা করিয়া এমন করিয়া মিছামিছি পীড়ন কর।”

বিনোদিনী যেন আশ্চর্য হইয়া কহিল, “সে কী, ভাই! আমি তোমাকে পীড়ন কী করিলাম। তবে কি তোমার ঘরে আসা আমার দোষ হইয়াছে। কাজ নাই, আমি যাই।” বলিয়া বিমর্ষমুখে উঠিবার উপক্রম করিল।

মহেন্দ্র তাহার হাত ধরিয়া ফেলিয়া কহিল, “অমনি করিয়াই তো তুমি আমাকে দগ্ধ কর।”

বিনোদিনী কহিল, “ইস, আমার যে এত তেজ, তাহা তো আমি জানিতাম না তোমারও তো প্রাণ কঠিন কম নয়, অনেক সহ্য করিতে পার। খুব যে ঝলসিয়া-পুড়িয়া গেছ, চেহারা দেখিয়া তাহা কিছু বুঝিবার জো নাই।”

মহেন্দ্র কহিল, “চেহারায় কী বুঝিবে।” বলিয়া বিনোদিনীর হাত বলপূর্বক লইয়া নিজের বুকের উপর চাপিয়া ধরিল।

বিনোদিনী “উঃ” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিতেই মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়া দিয়া কহিল, “লাগিল কি।”

দেখিল, কাল বিনোদিনীর হাতের যেখানটা কাটিয়া গিয়াছিল, সেইখান দিয়া আবার রক্ত পড়িতে লাগিল। মহেন্দ্র অনুতপ্ত হইয়া কহিল, “আমি ভুলিয়া গিয়াছিলাম–ভারি অন্যায় করিয়াছি। আজ কিন্তু এখনই তোমার ও -জায়গাটা বাঁধিয়া ওষুধ লাগাইয়া দিব–কিছুতেই ছাড়িব না।”

বিনোদিনী কহিল, “না, ও কিছুই না। আমি ওষুধ দিব না।”

মহেন্দ্র কহিল, “কেন দিবে না।”

বিনোদিনী কহিল, “কেন আবার কী। তোমার আর ডাক্তারি করিতে হইবে না, ও যেমন আছে থাক্‌।”

মহেন্দ্র মুহূর্তের মধ্যে গম্ভীর হইয়া গেল–মনে মনে কহিল, “কিছুই বুঝিবার জো নাই। স্ত্রীলোকের মন!’

বিনোদিনী উঠিল। অভিমানী মহেন্দ্র বাধা না দিয়া কহিল, “কোথায় যাইতেছ।”

বিনোদিনী কহিল, “কাজ আছে।” বলিয়া ধীরপদে চলিয়া গেল।

মিনিটখানেক বসিয়াই মহেন্দ্র বিনোদিনীকে ফিরাইয়া আনিবার জন্য দ্রুত উঠিয়া পড়িল; সিঁড়ির কাছ পর্যন্ত গিয়াই ফিরিয়া আসিয়া একলা ছাদে বেড়াইতে লাগিল।

বিনোদিনী অহরহ আকর্ষণও করে, অথচ বিনোদিনী এক মুহূর্ত কাছে আসিতেও দেয় না। অন্যে তাহাকে জিনিতে পারে না, এ গর্ব মহেন্দ্রের ছিল, তাহা সে সম্প্রতি বিসর্জন দিয়াছে–কিন্তু চেষ্টা করিলেই অন্যকে সে জিনিতে পারে, এ গর্বটুকুও কি রাখিতে পারিবে না। আজ সে হার মানিল, অথচ হার মানাইতে পারিল না। হৃদয়ক্ষেত্রে মহেন্দ্রের মাথা বড়ো উচ্চেই ছিল–সে কাহাকেও আপনার সমকক্ষ বলিয়া জানিত না–আজ সেইখানেই তাহাকে ধুলায় মাথা লুটাইতে হইল। যে শ্রেষ্ঠতা হারাইল তাহার বদলে কিছু পাইলও না। ভিক্ষুকের মতো রুদ্ধ দ্বারের সম্মুখে সন্ধ্যার সময় রিক্তহস্তে পথে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইল।

ফাল্গুন-চৈত্রমাসে বিহারীদের জমিদারি হইতে সরষে-ফুলের মধু আসিত, প্রতিবৎসরই সে তাহা রাজলক্ষ্মীকে পাঠাইয়া দিত–এবারও পাঠাইয়া দিল।

বিনোদিনী মধুভাণ্ড লইয়া স্বয়ং রাজলক্ষ্মীর কাছে গিয়া কহিল, “পিসিমা, বিহারী-ঠাকুরপো মধু পাঠাইয়াছেন।”

রাজলক্ষ্মী তাহা ভাঁড়ারে তুলিয়া রাখিতে উপদেশ দিলেন। বিনোদিনী মধু তুলিয়া আসিয়া রাজলক্ষ্মীর কাছে বসিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো কখনো তোমাদের তত্ত্ব লইতে ভোলেন না। বেচারার নিজের মা নাই নাকি, তাই তোমাকেই মার মতো দেখেন।”

বিহারীকে রাজলক্ষ্মী এমনি মহেন্দ্রের ছায়া বলিয়া জানিতেন যে, তাহার কথা তিনি বিশেষ-কিছু ভাবিতেন না–সে তাঁহাদের বিনা-মূল্যের বিনা-যত্নের বিনা-চিন্তার অনুগত লোক ছিল। বিনোদিনী যখন রাজলক্ষ্মীকে মাতৃহীন বিহারীর মাতৃস্থানীয়া বলিয়া উল্লেখ করিল, তখন রাজলক্ষ্মীর মাতৃহৃদয় অকস্মাৎ স্পর্শ করিল। হঠাৎ মনে হইল, “তা বটে, বিহারীর মা নাই এবং আমাকেই সে মার মতো দেখে।’ মনে পড়িল, রোগে তাপে সংকটে বিহারী বরাবর বিনা আহ্বানে, বিনা আড়ম্বরে তাঁহাকে নিঃশব্দ নিষ্ঠার সহিত সেবা করিয়াছে; রাজলক্ষ্মী তাহা নিশ্বাসপ্রশ্বাসের মতো সহজে গ্রহণ করিয়াছেন এবং সেজন্য কাহারো কাছে কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা তাঁহার মনেও উদয় হয় নাই। কিন্তু বিহারীর খোঁজখবর কে রাখিয়াছে। যখন অন্নপূর্ণা ছিলেন তিনি রাখিতেন বটে–রাজলক্ষ্মী ভাবিতেন, “বিহারীকে বশে রাখিবার জন্য অন্নপূর্ণা স্নেহের আড়ম্বর করিতেছেন।’

রাজলক্ষ্মী আজ নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “বিহারী আমার আপন ছেলের মতোই বটে।”

বলিয়াই মনে উদয় হইল, বিহারী তাঁহার আপন ছেলের চেয়ে ঢের বেশি করে–এবং কখনো বিশেষ কিছু প্রতিদান না পাইয়াও তাঁহাদের প্রতি সে ভক্তি স্থির রাখিয়াছে। ইহা ভাবিয়া তাঁহার অন্তরের মধ্য হইতে দীর্ঘনিশ্বাস পড়িল।

0 Shares