চোখের বালি

বিনোদিনী কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো তোমার হাতের রান্না খাইতে বড়ো ভালোবাসেন।”

রাজলক্ষ্মী সস্নেহগর্বে কহিলেন, “আর-কারো মাছের ঝোল তাহার মুখে রোচে না।”

বলিতে বলিতে মনে পড়িল, অনেক দিন বিহারী আসে নাই। কহিলেন, “আচ্ছা বউ, বিহারীকে আজকাল দেখিতে পাই না কেন।”

বিনোদিনী কহিল, “আমিও তো তাই ভাবিতেছিলাম, পিসিমা। তা, তোমারছেলেটি বিবাহের পর হইতে নিজের বউকে লইয়াই এমনি মাতিয়া রহিয়াছে–বন্ধুবান্ধবরা আসিয়া আর কী করিবে বলো।”

কথাটা রাজলক্ষ্মীর অত্যন্ত সংগত বোধ হইল। স্ত্রীকে লইয়া মহেন্দ্র তাহার সমস্ত হিতৈষীদের দূর করিয়াছে। বিহারীর তো অভিমান হইতেই পারে–কেন সে আসিবে। বিহারীকে নিজের দলে পাইয়া তাহার প্রতি রাজলক্ষ্মীর সমবেদনা বাড়িয়া উঠিল। বিহারী যে ছেলেবেলা হইতে একান্ত নিঃস্বার্থভাবে মহেন্দ্রের কত উপকার করিয়াছে, তাহার জন্য কতবার কত কষ্ট সহ্য করিয়াছে, সে সমস্ত তিনি বিনোদিনীর কাছে বিবৃত করিয়া বলিতে লাগিলেন–ছেলের উপর তাঁহার নিজের যা নালিশ তা বিহারীর বিবরণ দ্বারা সমর্থন করিতে লাগিলেন। দুদিন বউকে পাইয়া মহেন্দ্র যদি তাহার চিরকালের বন্ধুকে এমন অনাদর করে, তবে সংসারে ন্যায়ধর্ম আর রহিল কোথায়।

বিনোদিনী কহিল, “কাল রবিবার আছে, তুমি বিহারী-ঠাকুরপোকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াও, তিনি খুশি হইবেন।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “ঠিক বলিয়াছ বউ, তা হইলে মহিনকে ডাকাই, সে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইবে।”

বিনোদিনী। না পিসিমা, তুমি নিজে নিমন্ত্রণ করো।

রাজনক্ষ্ণী। আমি কি তোমাদের মতো লিখিতে পড়িতে জানি।

বিনোদিনী। তা হোক, তোমার হইয়া না-হয় আমিই লিখিয়া দিতেছি।

বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর নাম দিয়া নিজেই নিমন্ত্রণ-চিঠি লিখিয়া পাঠাইল।

রবিবার দিন মহেন্দ্রের অত্যন্ত আগ্রহের দিন। পূর্বরাত্রি হইতেই তাহার কল্পনা উদ্দাম হইয়া থাকে, যদিও এ পর্যন্ত তাহার কল্পনার অনুরূপ কিছুই হয় নাই–তবু রবিবারের ভোরের আলো তাহার চক্ষে মধুবর্ষণ করিতে লাগিল। জাগ্রত নগরীর সমস্ত কোলাহল তাহার কানে অপরূপ সংগীতের মতো আসিয়া প্রবেশ করিল।

কিন্তু ব্যাপারখানা কী। মার আজ কোনো ব্রত আছে নাকি! অন্যদিনের মতো বিনোদিনীর প্রতি গৃহকর্মের ভার দিয়া তিনি তো বিশ্রাম করিতেছেন না। আজ তিনি নিজেই ব্যস্ত হইয়া বেড়াইতেছেন।

এই হাঙ্গামে দশটা বাজিয়া গেল–ইতিমধ্যে মহেন্দ্র কোনো ছুতায় বিনোদিনির সঙ্গে এক মুহূর্ত বিরলে দেখা করিতে পারিল না। বই পড়িতে চেষ্টা করিল, পড়ায় কিছুতেই মন বসিল না–খবরের কাগজের একটা অনাবশ্যক বিজ্ঞাপনে পনেরো মিনিট দৃষ্টি আবদ্ধ হইয়া রহিল। আর থাকিতে পারিল না। নীচে গিয়া দেখিল, মা তাঁহার ঘরের বারান্দায় একটা তোলা উনানে রাঁধিতেছেন এবং বিনোদিনী কটিদেশে দৃঢ় করিয়া আঁচল জড়াইয়া জোগান দিতে ব্যস্ত।

মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল,”আজ তোমাদের ব্যাপারটা কী। এত ধুমধাম যে!”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ তোমাকে বলে নাই? আজ যে বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিয়াছি।”

বিহারীকে নিমন্ত্রণ! মহেন্দ্রের সর্বশরীর জ্বলিয়া উঠিল। তৎক্ষণাৎ কহিল, “কিন্তু মা, আমি তো থাকিতে পারিব না।”

রাজলক্ষ্মী। কেন।

মহেন্দ্র। আমার যে বাহিরে যাইতে হইবে।

রাজলক্ষ্মী। খাওয়াদাওয়া করিয়া যাস, বেশি দেরি হইবে না।

মহেন্দ্র। আমার যে বাহিরে নিমন্ত্রণ আছে।

বিনোদিনী মুহূর্তের জন্য মহেন্দ্রের মুখে কটাক্ষপাত করিয়া কহিল, “যদি নিমন্ত্রণ থাকে, তা হইলে উনি যান-না, পিসিমা। নাহয় আজ বিহারী-ঠাকুরপো একলাই খাইবেন।”

কিন্তু নিজের হাতের যত্নের রান্না মহিনকে খাওয়াইতে পারিবেন না, ইহা রাজলক্ষ্মীর সহিবে কেন। তিনি যতই পীড়াপীড়ি করিতে লাগিলেন, মহিন ততই বাঁকিয়া দাঁড়াইল। “অত্যন্ত জরুরি নিমন্ত্রণ, কিছুতেই কাটাইবার জো নাই–বিহারীকে নিমন্ত্রণ করিবার পূর্বে আমার সহিত পরামর্শ করা উচিত ছিল’ ইত্যাদি।

রাগ করিয়া মহেন্দ্র এইরূপে মাকে শান্তি দিবার ব্যবস্থা করিল। রাজলক্ষ্মীর সমস্ত উৎসাহ চলিয়া গেল। তাঁহার ইচ্ছা হইল, রান্না ফেলিয়া তিনি চলিয়া যান। বিনোদিনী কহিল,”পিসিমা, তুমি কিছু ভাবিয়ো না–ঠাকুরপো মুখে আস্ফালন করিতেছেন, কিন্তু আজ উহার বাহিরে নিমন্ত্রণে যাওয়া হইতেছে না।”

রাজলক্ষ্মী মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “না বাছা, তুমি মহিনকে জান না, ও যা একবার ধরে তা কিছুতেই ছাড়ে না।”

কিন্তু বিনোদিনী মহেন্দ্রকে রাজলক্ষ্মীর চেয়ে কম জানে না, তাহাই প্রমাণ হইল। মহেন্দ্র বুঝিয়াছিল, বিহারীকে বিনোদিনীই নিমন্ত্রণ করাইয়াছে। ইহাতে তাহার হৃদয় ঈর্ষায় যতই পীড়িত হইতে লাগিল,ততই তাহার পক্ষে দূরে যাওয়া কঠিন হইল। বিহারী কী করে, বিনোদিনী কী করে, তাহা না দেখিয়া সে বাঁচিবে কী করিয়া। দেখিয়া জ্বলিতে হইবে, কিন্তু দেখাও চাই।

বিহারী আজ অনেক দিন পরে নিমন্ত্রিত-আত্মীয়ভাবে মহেন্দ্রের অন্তঃপুরে প্রবেশ করিল। বাল্যকাল হইতে যে ঘর তাহার পরিচিত এবং যেখানে সে ঘরের ছেলের মতো অবারিতভাবে প্রবেশ করিয়া দৌরাত্ন্য করিয়াছে, তাহার দ্বারের কাছে আসিয়া মূহূর্তের জন্য সে থমকিয়া দাঁড়াইল–একটা অশ্রুতরঙ্গ পলকের মধ্যে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিবার জন্য তাহার বক্ষকবাটে আঘাত করিল। সেই আঘাত সংবরণ করিয়া লইয়া সে স্মিতহাস্যে ঘরে প্রবেশ করিয়া সদ্যঃস্নাতা রাজলক্ষ্মীকে প্রণাম করিয়া তাঁহার পায়ের ধুলা লইল। বিহারী যখন সর্বদা যাতায়াত করিত তখন এরূপ অভিবাদন তাহাদের প্রথা ছিল না। আজ যেন সে বহুদূর প্রবাস হইতে পুনর্বার ঘরে ফিরিয়া আসিল। বিহারী প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় রাজলক্ষ্মী সস্নেহে তাহার মাথায় হস্তস্পর্শ করিলেন।

0 Shares