চোখের বালি

রাজলক্ষ্মী আজ নিগূঢ় সহানুভূতিবশত বিহারীর প্রতি পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি আদর ও স্নেহ প্রকাশ করিলেন। কহিলেন,”ও বেহারি, তুই এতদিন আসিস নাই কেন। আমি রোজ মনে করিতাম, আজ, নিশ্চয় বেহারি আসিবে, কিন্তু তোর আর দেখা নাই।”

বিহারী হাসিয়া কহিল,”রোজ আসিলে তো তোমার বিহারীকে রোজ মনে করিতে না, মা। মহিনদা কোথায়।”

রাজলক্ষ্মী বিমর্ষ হইয়া কহিলেন,”মহিনের আজ কোথায় নিমন্ত্রণ আছে, সে আজ কিছুতেই থাকিতে পারিল না।”

শুনিবামাত্র বিহারীর মনটা বিকল হইয়া গেল। আশৈশব প্রণয়ের শেষ এই পরিণাম? একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মন হইতে সমস্ত বিষাদবাষ্প উপস্থিতমত তাড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বিহারী জিজ্ঞাসা করিল, “আজ কী রান্না হইয়াছে শুনি।” বলিয়া তাহার নিজের প্রিয় ব্যঞ্জনগুলির কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মীর রন্ধনের দিন বিহারী কিছু অতিরিক্ত আড়ম্বর করিয়া নিজেকে লুব্ধ বলিয়া পরিচয় দিত–আহারলোলুপতা দেখাইয়া বিহারী মাতৃহৃদয়শালিনী রাজলক্ষ্মীর স্নেহ কাড়িয়া লইত। আজও তাঁহার স্বরচিত ব্যঞ্জন সম্বন্ধে বিহারীর অতিমাত্রায় কৌতূহল দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী হাসিতে হাসিতে তাঁহার লোভাতুর অতিথিকে আশ্বাস দিলেন।

এমন সময় মহেন্দ্র আসিয়া বিহারীকে শুষ্কস্বরে দস্তুরমত জিজ্ঞাসা করিল, “কী বিহারী, কেমন আছ।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কই মহিন, তুই তোর নিমন্ত্রণে গেলি না?”

মহেন্দ্র লজ্জা ঢাকিতে চেষ্টা করিয়া কহিল, “না, সেটা কাটাইয়া দেওয়া গেছে।”

স্নান করিয়া আসিয়া বিনোদিনী যখন দেখা দিল, তখন বিহারী প্রথমটা কিছুই বলিতে পারিল না। বিনোদিনী ও মহেন্দ্রের যে-দৃশ্য সে দেখিয়াছিল, তাহা তাহার মনে মুদ্রিত ছিল।

বিনোদিনী বিহারীর অনতিদূরে আসিয়া মৃদুস্বরে কহিল, “কী ঠাকুরপো, একেবারে চিনিতেই পার না নাকি।”

বিহারী কহিল, “সকলকেই কি চেনা যায়।”

বিনোদিনী কহিল, “একটু বিবেচনা থাকিলেই যায়।” বলিয়া খবর দিল, “পিসিমা, খাবার প্রস্তুত হইয়াছে।”

মহেন্দ্র-বিহারী খাইতে বসিল; রাজলক্ষ্মী অদূরে বসিয়া দেখিতে লাগিলেন এবং বিনোদিনী পরিবেশন করিতে লাগিল।

মহেন্দ্রের খাওয়ার মনোযোগ ছিল না, সে কেবল পরিবেশনে পক্ষপাত লক্ষ্য করিতে লাগিল। মহেন্দ্রের মনে হইল, বিহারীকে পরিবেশন করিয়া বিনোদিনী যেন একটা বিশেষ সুখ পাইতেছে। বিহারীর পাতেই যে বিশেষ করিয়া মাছের মুড়া ও দধির সর পড়িল, তাহার উত্তম কৈফিয়ত ছিল–মহেন্দ্র ঘরের ছেলে, বিহারী নিমন্ত্রিত। কিন্তু মুখ ফুটিয়া নালিশ করিবার ভালো হেতুবাদ ছিল না বলিয়াই মহেন্দ্র আরো বেশি করিয়া জ্বলিতে লাগিল। অসময়ে বিশেষ সন্ধানে তপসিমাছ পাওয়া গিয়াছিল, তাহার মধ্যে একটি ডিমওয়ালা ছিল; সেই মাছটি বিনোদিনী বিহারীর পাতে দিতে গেলে বিহারী কহিল, “না না, মহিনদাকে দাও, মহিনদা ভালোবাসে।” মহেন্দ্র তীব্র অভিমানে বলিয়া উঠিল, “না না, আমি চাই না।” শুনিয়া বিনোদিনী দ্বিতীয় বার অনুরোধ মাত্র না করিয়া সে-মাছ বিহারীর পাতে ফেলিয়া দিল।

আহারান্তে দুই বন্ধু উঠিয়া ঘরের বাহিরে আসিলে বিনোদিনী তাড়াতাড়ি আসিয়া কহিল, “বিহারী ঠাকুরপো, এখনই যাইয়ো না, উপরের ঘরে একটু বসিবে চলো।”

বিহারী কহিল, “তুমি খাইতে যাইবে না?”

বিনোদিনী কহিল, “না, আজ একাদশী।”

নিষ্ঠুর বিদ্রূপের একটি সূক্ষ্ণ হাস্যরেখা বিহারীর ওষ্ঠপ্রান্তে দেখা দিল–তাহার অর্থ এই যে, একাদশী-করাও আছে। অনুষ্ঠানের ত্রুটি নাই।

সেই হাস্যের আভাসটুকু বিনোদিনীর দৃষ্টি এড়ায় নাই–তবু সে যেমন তাহার হাতের কাটা ঘা সহ্য করিয়াছিল; তেমনি করিয়া ইহাও সহ্য করিল। নিতান্ত মিনতির স্বরে কহিল, “আমার মাথা খাও, একবার বসিবে চলো।”

মহেন্দ্র হঠাৎ অসংগতভাবে উত্তেজিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তোমাদের কিছুই তো বিবেচনা নাই–কাজ থাক্‌ কর্ম থাক্‌, ইচ্ছা থাক্‌ বা না থাক্‌, তবু বসিতেই হইবে। এত অধিক আদরের আমি তো কোনো মানে বুঝিতে পারি না।”

বিনোদিনী উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো, শোনো একবার, তোমার মহিনদার কথা শোনো। আদরের মানে আদর, অভিধানে তাহার আর কোনো দ্বিতীয় মানে লেখে না।” (মহেন্দ্রের প্রতি) “যাই বল ঠাকুরপো, অধিক আদরের মানে শিশুকাল হইতে তুমি যত পরিষ্কার বোঝ, এমন আর কেহ বোঝে না।”

বিহারী কহিল, “মহিনদা, একটা কথা আছে, একবার শুনিয়া যাও।” বলিয়া বিহারী বিনোদিনীকে কোনো বিদায়সম্ভাষণ না করিয়া মহেন্দ্রকে লইয়া বাহিরে গেল। বিনোদিনী বারান্দার রেলিং ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া শূন্য উঠানের শূন্যতার দিকে তাকাইয়া রহিল।

বিহারী বাহিরে আসিয়া কহিল, “মহিনদা, আমি জানিতে চাই, এইখানে কি আমাদের বন্ধুত্ব শেষ হইল।'”

মহেন্দ্রের বুকের ভিতর তখন জ্বলিতেছিল, বিনোদিনীর পরিহাস-হাস্য বিদ্যুৎশিখার মতো তাহার মস্তিকের এক প্রান্ত হইতে আর-এক প্রান্ত বারংবার ফিরিয়া ফিরিয়া বিঁধিতেছিল–সে কহিল, “মিটমাট হইলে তোমার তাহাতে বিশেষ সুবিধা হইতে পারে, কিন্তু আমার কাছে তাহা প্রার্থনীয় বোধ হয় না। আমার সংসারের মধ্যে আমি বাহিরের লোক ঢুকাইতে চাই না–অন্তঃপুরকে আমি অন্তঃপুর রাখিতে চাই।”

বিহারী কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল।

0 Shares