চোখের বালি

চিঠিখানা খুলিয়া দেখিতেছে, এমন সময় তাড়াতাড়ি মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে আসিয়া প্রবেশ করিল। হঠাৎ কী মনে করিয়া কালেজের একটা লেকচারের মাঝখানে ভঙ্গ দিয়া সে ছুটিয়া বাড়ি চলিয়া আসিয়াছে।

আশা চিঠিখানা অঞ্চলের মধ্যে লুকাইয়া ফেলিল। মহেন্দ্রও ঘরে আশাকে দেখিয়া একটু থমকিয়া দাঁড়াইল। তাহার পর ব্যগ্রদৃষ্টিতে ঘরের এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিতে লাগিল। আশা বুঝিয়াছিল, মহেন্দ্র কী খুঁজিতেছে; কিন্তু কেমন করিয়া সে হাতের চিঠিখানা অলক্ষিতে যথাস্থানে রাখিয়া পালাইয়া যাইবে, ভাবিয়া পাইল না। মহেন্দ্র তখন একটা একটা করিয়া ময়লা কাপড় তুলিয়া তুলিয়া দেখিতে লাগিল। মহেন্দ্রের সেই নিষ্ফল প্রয়াস দেখিয়া আশা আর থাকিতে পারিল না, চিঠিখানা ও জামাটা মেজের উপর ফেলিয়া দিয়া ডান হাতে খাটের থামটা ধরিয়া সেই হাতে মুখ লুকাইল। মহেন্দ্র বিদ্যুদ্‌বেগে চিঠিখানা তুলিয়া লইল। নিমেষের জন্য স্তব্ধ হইয়া আশার দিকে চাহিল। তাহার পরে আশা সিঁড়ি দিয়া মহেন্দ্রের দ্রুতধাবনের শব্দ শুনিতে পাইল। তখন ধোবা ডাকিতেছে, “মাঠাকরুন, কাপড় দিতে আর কত দেরি করিবে। বেলা অনেক হইল, আমার বাড়ি তো এখানে নয়।”

৩৪

রাজলক্ষ্মী আজ সকাল হইতে আর বিনোদিনীকে ডাকেন নাই। বিনোদিনী নিয়মমত ভাঁড়ারে গেল, দেখিয়া, রাজলক্ষ্মী মুখ তুলিয়া চাহিলেন না।

সে তাহা লক্ষ্য করিয়াও বলিল, “পিসিমা, তোমার অসুখ করিয়াছে বুঝি? করিবারই কথা। কাল রাত্রে ঠাকুরপো যে কীর্তি করিলেন। একেবারে পাগলের মতো আসিয়া উপস্থিত। আমার তো তার পরে ঘুম হইল না।”

রাজলক্ষ্মী মুখ ভার করিয়া রহিলেন, হাঁ-না কোনো উত্তরই করিলেন না।

বিনোদিনী বলিল, “হয়তো চোখের বালির সঙ্গে সামান্য কিছু খিটিমিটি হইয়া থাকিবে, আর দেখে কে। তখনই নালিশ কিংবা নিষ্পত্তির জন্যে আমাকে ধরিয়া লইয়া যাওয়া চাই, রাত পোহাইতে তর সয় না। যাই বল পিসিমা, তুমি রাগ করিয়ো না, তোমার ছেলের সহস্র গুণ থাকিতে পারে, কিন্তু ধৈর্যের লেশমাত্র নাই। ঐজন্যেই আমার সঙ্গে কেবলই ঝগড়া হয়।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “বউ, তুমি মিথ্যা বকিতেছ–আমার আজ আর কোনো কথা ভালো লাগিতেছে না।”

বিনোদিনী কহিল, “আমারও কিছু ভালো লাগিতেছে না, পিসিমা। তোমার মনে আঘাত লাগিবে, এই ভয়ে মিথ্যা কথা দিয়া তোমার ছেলের দোষ ঢাকিবার চেষ্টা করিয়াছি। কিন্তু এমন হইয়াছে যে আর ঢাকা পড়ে না।”

রাজলক্ষ্মী। আমার ছেলের দোষ-গুণ আমি জানি–কিন্তু তুমি যে কেমন মায়াবিনী, তাহা আমি জানিতাম না!

বিনোদিনী কী একটা বলিবার জন্য উদ্যত হইয়া নিজেকে সংবরণ করিল–কহিল, “সে কথা ঠিক পিসিমা, কেহ কাহাকেও জানে না। নিজের মনও কি সবাই জানে। তুমি কি কখনো তোমার বউয়ের উপর দ্বেষ করিয়া এই মায়াবিনীকে দিয়া তোমার ছেলের মন ভুলাইতে চাও নাই? একবার ঠাওর করিয়া দেখো দেখি।”

রাজলক্ষ্মী অগ্নির মতো উদ্দীপ্ত হইয়া উঠিলেন–কহিলেন, “হতভাগিনী, ছেলের সম্বন্ধে মার নামে তুই এমন অপবাদ দিতে পারিস? তোর জিব খসিয়া পড়িবে না!”

বিনোদিনী অবিচলিতভাবে কহিল, “পিসিমা, আমরা মায়াবিনীর জাত, আমার মধ্যে কী মায়া ছিল, তাহা আমি ঠিক জানি নাই, তুমি জানিয়াছ–তোমার মধ্যেও কী মায়া ছিল, তাহা তুমি ঠিক জান নাই, আমি জানিয়াছি। কিন্তু মায়া ছিল, নহিলে এমন ঘটনা ঘটিত না। ফাঁদ আমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না জানিয়া পাতিয়াছি। ফাঁদ তুমিও কতকটা জানিয়া এবং কতকটা না জানিয়া পাতিয়াছ। আমাদের জাতের ধর্ম এইরূপ–আমরা মায়াবিনী।”

রোষে রাজলক্ষ্মীর যেন কণ্ঠরোধ হইয়া গেল–তিনি ঘর ছাড়িয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন।

বিনোদিনী একলা ঘরে ক্ষণকালের জন্য স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল–তাহার দুই চক্ষে আগুন জ্বলিয়া উঠিল।

সকালবেলাকার গৃহকার্য হইয়া গেলে রাজলক্ষ্মী মহেন্দ্রকে ডাকিয়া পাঠাইলেন। মহেন্দ্র বুঝিল, কাল রাত্রিকার ব্যাপার লইয়া আলোচনা হইবে। তখন বিনোদিনীর কাছ হইতে পত্রোত্তর পাইয়া তাহার মন বিকল হইয়া উঠিয়াছিল। সেই আঘাতের প্রতিঘাত স্বরূপে তাহার সমস্ত তরঙ্গিত হৃদয় বিনোদিনীর দিকে সবেগে ধাবমান হইতেছিল। ইহার উপরে আবার মার সঙ্গে উত্তর-প্রত্যুত্তর করা তাহার পক্ষে অসাধ্য। মহেন্দ্র জানিত, মা তাহাকে বিনোদিনী সম্বন্ধে ভর্ৎসনা করিলেই বিদ্রোহিভাবে সে যথার্থ মনের কথা বলিয়া ফেলিবে এবং বলিয়া ফেলিলেই নিদারুণ গৃহযুদ্ধ আরম্ভ হইবে। অতএব এ সময়ে বাড়ি হইতে দূরে গিয়া সকল কথা পরিষ্কার করিয়া ভাবিয়া দেখা দরকার। মহেন্দ্র চাকরকে বলিল, “মাকে বলিস, আজ কালেজে আমার বিশেষ কাজ আছে, এখনই যাইতে হইবে, ফিরিয়া আসিয়া দেখা হইবে।” বলিয়া পলাতক বালকের মতো তখনই তাড়াতাড়ি কাপড় পরিয়া না খাইয়া ছুটিয়া বাহির হইতে গেল। বিনোদিনীর যে দারুণ চিঠিখানা আজ সকাল হইতে বার বার করিয়া সে পড়িয়াছে এবং পকেটে লইয়া ফিরিয়াছে, আজ নিতান্ত তাড়াতাড়িতে সেই চিঠিসুদ্ধ জামা ছাড়িয়াই সে চলিয়া গেল।

এক পশলা ঘন বৃষ্টি হইয়া তাহার পরে বাদলার মতো করিয়া রহিল। বিনোদিনীর মন আজ অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া আছে। মনের কোনো অসুখ হইলে বিনোদিনী কাজের মাত্রা বাড়ায়। তাই সে আজ যত রাজ্যের কাপড় জড়ো করিয়া চিহ্ন দিতে আরম্ভ করিয়াছে। আশার নিকট হইতে কাপড় চাহিতে গিয়া আশার মুখের ভাব দেখিয়া তাহার মন আরো বিগড়াইয়া গেছে। সংসারে যদি অপরাধীই হইতে হয় তবে অপরাধের যত লাঞ্ছনা তাহাই কেন ভোগ করিবে, অপরাধের যত সুখ তাহা হইতে কেন বঞ্চিত হইবে।

0 Shares