চোখের বালি

আশার হৃৎপিণ্ডে রক্ত ধক্‌ করিয়া ঘা দিল। এক পলকের মধ্যে সহস্র আশ্বাস ও আশঙ্কা একসঙ্গে তাহার বক্ষে বাজিয়া উঠিল। তাড়াতাড়ি মাথা তুলিয়া চিঠিখানা লইয়া দেখিল, মহেন্দ্রের হাতের অক্ষরে বিনোদিনীর নাম। তৎক্ষণাৎ তাহার মাথা বালিশের উপরে পড়িয়া গেল–কোনো কথা না বলিয়া আশা সে চিঠি বেহারার হাতে ফিরাইয়া দিল। বেহারা জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠি কাহাকে দিতে হইবে।”

আশা কহিল, “জানি না।”

রাত্রি তখন আটটা হইবে, মহেন্দ্র তাড়াতাড়ি ঝড়ের মতো বিনোদিনীর ঘরের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল, দেখিল–ঘরে আলো নাই, সমস্ত অন্ধকার। পকেট হইতে একটা দেশালাইয়ের বাক্স বাহির করিয়া দেশালাই ধরাইল–দেখিল, ঘর শূন্য। বিনোদিনী নাই, তাহার জিনিসপত্রও নাই। দক্ষিণের বারান্দায় গিয়া দেখিল, বারান্দা নির্জন। ডাকিল, “বিনোদ।” কোনো উত্তর আসিল না।

“নির্বোধ। আমি নির্বোধ। তখনই সঙ্গে করিয়া লইয়া যাওয়া উচিত ছিল। নিশ্চয়ই মা বিনোদিনীকে এমন গঞ্জনা দিয়াছেন যে, সে ঘরে টিকিতে পারে নাই।’

সেই কল্পনামাত্র মনে উদয় হইতেই, তাহা নিশ্চয় সত্য বলিয়া তাহার মনে বিশ্বাস হইল। মহেন্দ্র অধীর হইয়া তৎক্ষণাৎ মার ঘরে গেল। সে-ঘরেও আলো নাই–কিন্তু রাজলক্ষ্মী বিছানায় শুইয়া আছেন, তাহা অন্ধকারেও লক্ষ্য হইল। মহেন্দ্র একেবারেই রুষ্টস্বরে বলিয়া উঠিল, “মা, তোমরা বিনোদিনীকে কী বলিয়াছ।”

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “কিছুই বলি নাই।”

মহেন্দ্র। তবে সে কোথায় গেছে।

রাজলক্ষ্মী। আমি কী জানি।

মহেন্দ্র অবিশ্বাসের স্বরে কহিল, “তুমি জান না? আচ্ছা, আমি তাহার সন্ধানে চলিলাম–সে যেখানেই থাক্‌, আমি তাহাকে বাহির করিবই।”

বলিয়া মহেন্দ্র চলিয়া গেল। রাজলক্ষ্মী তাড়াতাড়ি বিছানা হইতে উঠিয়া তাহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিতে চলিতে বলিতে লাগিলেন, “মহিন, যাস নে মহিন, ফিরিয়া আয়, আমার একটা কথা শুনিয়া যা।”

মহেন্দ্র এক নিশ্বাসে ছুটিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। মুহূর্ত পরেই ফিরিয়া আসিয়া দরোয়ানকে জিজ্ঞাসা করিল, “বহুঠাকুরানী কোথায় গিয়াছেন।”

দরোয়ান কহিল, “আমাদের বলিয়া যান নাই, আমরা কিছুই জানি না।”

মহেন্দ্র গর্জিত ভর্ৎসনার স্বরে কহিল, “জান না!”

দরোয়ান করজোড়ে কহিল, “না মহারাজ, জানি না।”

মহেন্দ্র মনে মনে স্থির করিল, “মা ইহাদের শিখাইয়া দিয়াছেন।’ কহিল, “আচ্ছা, তা হউক।”

মহানগরীর রাজপথে গ্যাসালোকবিদ্ধ সন্ধ্যান্ধকারে বরফওয়ালা তখন বরফ ও তপ্‌সিমাছওয়ালা তপ্‌সিমাছ হাঁকিতেছিল। কলরবক্ষুদ্ধ জনতার মধ্যে মহেন্দ্র প্রবেশ করিল এবং অদৃশ্য হইয়া গেল।

৩৭

বিহারী একলা নিজেকে লইয়া অন্ধকার রাত্রে কখনো ধ্যান করিতে বসে না। কোনোকালেই বিহারী নিজের কাছে নিজেকে আলোচ্য বিষয় করে নাই। সে পড়াশুনা কাজকর্ম বন্ধুবান্ধব লোকজন লইয়াই থাকিত। চারি দিকের সংসারকেই সে নিজের চেয়ে প্রাধান্য দিয়া আনন্দে ছিল, কিন্তু হঠাৎ একদিন প্রবল আঘাতে তাহার চারি দিক যেন বিশ্লিষ্ট হইয়া পড়িয়া গেল; প্রলয়ের অন্ধকারে অভ্রভেদী বেদনার গিরিশৃঙ্গে নিজেকে একলা লইয়া দাঁড়াইতে হইল। সেই হইতে নিজের নির্জন সঙ্গকে সে ভয় করিতে আরম্ভ করিয়াছে; জোর করিয়া নিজের ঘাড়ে কাজ চাপাইয়া এই সঙ্গীটিকে সে কোনোমতেই অবকাশ দিতে চায় না।

কিন্তু আজ নিজের সেই অন্তরবাসীকে বিহারী কোনোমতেই ঠেলিয়া রাখিতে পারিল না। কাল বিনোদিনীকে বিহারী দেশে পৌঁছাইয়া দিয়া আসিয়াছে, তাহার পর হইতে সে যে-কোনো কাজে যে-কোনো লোকের সঙ্গেই আছে, তাহার গুহাশায়ী বেদনাতুর হৃদয় তাহাকে নিজের নিগূঢ় নির্জনতার দিকে অবিশ্রাম আকর্ষণ করিতেছে।

শ্রান্তি ও অবসাদে আজ বিহারীকে পরাস্ত করিল। রাত্রি তখন নয়টা হইবে; বিহারীর গৃহের সম্মুখবর্তী দক্ষিণের ছাদের উপর দিনান্তরম্য গ্রীষ্মের বাতাসউতলা হইয়া উঠিয়াছে। বিহারী চন্দ্রোদয়হীন অন্ধকারে ছাদে একখানি কেদারা লইয়া বসিয়া আছে।

বালক বসন্তকে আজ সন্ধ্যাবেলায় সে পড়ায় নাই–সকাল সকাল তাহাকে বিদায় করিয়া দিয়াছে। আজ সান্ত্বনার জন্য, সঙ্গের জন্য, তাহার চিরাভ্যস্ত প্রীতিসুধাস্নিগ্ধ পূর্বজীবনের জন্য তাহার হৃদয় যেন মাতৃপরিত্যক্ত শিশুর মতো বিশ্বের অন্ধকারের মধ্যে দুই বাহু তুলিয়া কাহাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। আজ তাহার দৃঢ়তা, তাহার কঠোর সংযমের বাঁধ কোথায় ভাঙিয়া গেছে। যাহাদের কথা ভাবিবে না পণ করিয়াছিল, সমস্ত হৃদয় তাহাদের দিকে ছুটিয়াছে, আজ আর পথরোধ করিবার লেশমাত্র বল নাই।

মহেন্দ্রের সহিত বাল্যকালের প্রণয় হইতে সেই প্রণয়ের অবসান পর্যন্ত সমস্ত কথা–যে সুদীর্ঘ কাহিনী নানাবর্ণে চিত্রিত, জলে-স্থলে পর্বতে নদীতে বিভক্ত মানচিত্রের মতো তাহার মনের মধ্যে গুটানো ছিল–বিহারী প্রসারিত করিয়া ধরিল। যে ক্ষুদ্র জগৎটুকুর উপর সে তাহার জীবনের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহা কোন্‌খানে কোন্‌ দুর্গ্রহের সহিত সংঘাত পাইল, তাহাই সে মনে করিয়া দেখিতে লাগিল। প্রথমে বাহির হইতে কে আসিল। সূর্যাস্তকালের করুণ রক্তিমচ্ছটায় আভাসিত আশার লজ্জামণ্ডিত তরুণ মুখখানি অন্ধকারে অঙ্কিত হইয়া উঠিল, তাহার সঙ্গে-সঙ্গে মঙ্গল-উৎসবের পূণ্যশঙ্খধ্বনি তাহার কানে বাজিতে লাগিল। এই শুভগ্রহ অদৃষ্টাকাশের অজ্ঞাত প্রান্ত হইতে আসিয়া দুই বন্ধুর মাঝখানে দাঁড়াইল–একটু যেন বিচ্ছেদ আনিল, কোথা হইতে এমন একটি গূঢ় বেদনা আনিয়া উপস্থিত করিল, যাহা মুখে বলিবার নহে, যাহা মনেও লালন করিতে নাই। কিন্তু তবু এই বিচ্ছেদ, এই বেদনা অপূর্ব স্নেহরঞ্জিত মাধুর্যরশ্মি দ্বারা আচ্ছন্ন পরিপূর্ণ হইয়া রহিল।

0 Shares