চোখের বালি

পূর্বপ্রথামত মনিব না থাকিলেও ভজু বেহারা মহেন্দ্রকে চা এবং বাজার হইতে জলখাবার আনিয়া খাওয়াইল। মহেন্দ্র স্নান ভুলিয়া গেল। উত্তপ্ত বালুকার উপর দিয়া পথিক যেমন দ্রুতপদে চলে, মহেন্দ্র সেইরূপ ক্ষণে ক্ষণে বিনোদিনীর জ্বালাকর চিঠির উপর দ্রুত চোখ বুলাইতে লাগিল। মহেন্দ্র পণ করিতে লাগিল, বিনোদিনীর সঙ্গে আর কিছুতেই দেখা করিবে না। কিন্তু তাহার মনে হইল, আর দুই-একদিন চিঠির জবাব না পাইলে বিনোদিনী বিহারীর বাড়িতে আসিয়া উপস্থিত হইবে এবং তখন সমস্ত অবস্থা জানিতে পারিয়া সান্ত্বনা লাভ করিবে। সে সম্ভাবনা তাহার কাছে অসহ্য বোধ হইল।

তখন চিঠিখানা পকেটে করিয়া মহেন্দ্র সন্ধ্যার কিছু পূর্বে পটলডাঙার বাসায় আসিয়া উপস্থিত হইল।

মহেন্দ্রের ম্লান অবস্থায় বিনোদিনীর মনে দয়া হইল–সে বুঝিতে পারিল, মহেন্দ্র কাল রাত্রে হয়তো পথে-পথে অনিদ্রায় যাপন করিয়াছে। জিজ্ঞাসা করিল, “কাল রাত্রে বাড়ি যাও নাই?”

মহেন্দ্র কহিল, “না।”

বিনোদিনী ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিল, “আজ এখনো তোমার খাওয়া হয় নি নাকি।” বলিয়া সেবাপরায়ণা বিনোদিনী তৎক্ষণাৎ আহারের আয়োজন করিতে উদ্যত হইল।

মহেন্দ্র কহিল, “থাক্‌ থাক্‌, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”

বিনোদিনী। কোথায় খাইয়াছ।

মহেন্দ্র। বিহারীদের বাড়িতে।

মুহূর্তের জন্য বিনোদিনীর মুখ পাণ্ডুবর্ণ হইয়া গেল। মুহূর্তকাল নিরুত্তর থাকিয়া আত্মসংবরণ করিয়া বিনোদিনী জিজ্ঞাসা করিল, “বিহারী-ঠাকুরপো ভালো আছেন তো?”

মহেন্দ্র কহিল, “ভালোই আছে। বিহারী যে পশ্চিমে চলিয়া গেল।” –মহেন্দ্র এমনভাবে বলিল, যেন বিহারী আজই রওনা হইয়াছে।

বিনোদিনীর মুখ আর-একবার পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। পুনর্বার আত্মসংবরণ করিয়া সে কহিল, “এমন চঞ্চল লোকও তো দেখি নাই। আমাদের সমস্ত খবর পাইয়াছেন বুঝি? ঠাকুরপো খুব কি রাগ করিয়াছেন।”

মহেন্দ্র। তা না হইলে এই অসহ্য গরমের সময় কি মানুষ শখ করিয়া পশ্চিমে বেড়াইতে যায়।

বিনোদিনী। আমার কথা কিছু বলিলেন না কি।

মহেন্দ্র। বলিবার আর কী আছে। এই লও বিহারীর চিঠি।

বলিয়া চিঠিখানা বিনোদিনীর হাতে দিয়া মহেন্দ্র তীব্রদৃষ্টিতে তাহার মুখের ভাব নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।

বিনোদিনী তাড়াতাড়ি চিঠি লইয়া দেখিল, খোলা চিঠি–লেফাফার উপরে তাহারই হস্তাক্ষরে বিহারীর নাম লেখা। লেফাফা হইতে বাহির করিয়া দেখিল, তাহারই লেখা সেই চিঠি। উল্‌টাইয়া পাল্‌টাইয়া কোথাও বিহারীর লেখা জবাব কিছুই দেখিতে পাইল না।

একটুখানি চুপ করিয়া থাকিয়া বিনোদিনী মহেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করিল, “চিঠিখানা তুমি পড়িয়াছ?”

বিনোদিনীর মুখের ভাব দেখিয়া মহেন্দ্রের মনে ভয়ের সঞ্চার হইল। সে ফস্‌ করিয়া মিথ্যা কথা কহিল, “না।”

বিনোদিনী চিঠিখানা টুকরা-টুকরা করিয়া ছিঁড়িয়া, পুনরায় তাহা কুটিকুটি করিয়া জানালার বাহিরে ফেলিয়া দিল।

মহেন্দ্র কহিল, “আমি বাড়ি যাইতেছি।”

বিনোদিনী তাহার কোনো উত্তর দিল না।

মহেন্দ্র। তুমি যেমন ইচ্ছা প্রকাশ করিয়াছ, আমি তাহাই করিব। সাত দিন আমি বাড়িতে থাকিব। কালেজে আসিবার সময় প্রত্যহ একবার এখানকার সমস্ত বন্দোবস্ত করিয়া খেমির হাতে দিয়া যাইব। দেখা করিয়া তোমাকে বিরক্ত করিব না।

বিনোদিনী মহেন্দ্রের কোনো কথা শুনিতে পাইল কি না কে জানে, কিন্তু কোনো উত্তর করিল না–খোলা জানালার বাহিরে অন্ধকার আকাশে চাহিয়া রহিল।

মহেন্দ্র তাহার জিনিসপত্র লইয়া বাহির হইয়া গেল।

বিনোদিনী শূন্যগৃহে অনেকক্ষণ আড়ষ্টের মতো বসিয়া থাকিয়া অবশেষে নিজেকে যেন প্রাণপণ বলে সচেতন করিবার জন্য বক্ষের কাপড় ছিঁড়িয়া আপনাকে নিষ্ঠুরভাবে আঘাত করিতে লাগিল।

খেমি শব্দ শুনিয়া ব্যস্ত হইয়া কহিল, “বউঠাকরুন, করিতেছ কী।”

“তুই যা এখান থেকে” বলিয়া গর্জন করিয়া উঠিয়া বিনোদিনী খেমিকে ঘর হইতে বাহির করিয়া দিল। তাহর পরে সশব্দে দ্বার রুদ্ধ করিয়া, দুই হাত মুঠা করিয়া, মাটিতে লুটাইয়া পড়িয়া, বাণাহত জন্তুর মতো আর্তস্বরে কাঁদিতে লাগিল। এইরূপে বিনোদিনী নিজেকে বিক্ষত পরিশ্রান্ত করিয়া মূর্ছিতের মতো মুক্ত বাতায়নের তলে সমস্ত রাত্রি পড়িয়া রহিল।

প্রাতঃকালে সূর্যালোক গৃহে প্রবেশ করিতেই তাহার হঠাৎ সন্দেহ হইল, বিহারী যদি না গিয়া থাকে, মহেন্দ্র যদি বিনোদিনীকে ভুলাইবার জন্য মিথ্যা বলিয়া থাকে। তৎক্ষণাৎ খেমিকে ডাকিয়া কহিল, “খেমি, তুই এখনই যা–বিহারী-ঠাকুরপোর বাড়ি গিয়া তাঁহাদের খবর লইয়া আয়।”

খেমি ঘণ্টাখানেক পরে ফিরিয়া আসিয়া কহিল, “বিহারীবাবুর বাড়ির সমস্ত জানালা দরজা বন্ধ। দরজায় ঘা দিতে ভিতর হইতে বেহারা বলিল, “বাবু বাড়িতে নাই, তিনি পশ্চিমে বেড়াইতে গিয়াছেন’।”

বিনোদিনীর মনে আর সন্দেহের কোনোই কারণ রহিল না।

৪২

রাত্রেই মহেন্দ্র শয্যা ছাড়িয়া গেছে শুনিয়া রাজলক্ষ্মী বধূর প্রতি অত্যন্ত রাগ করিলেন। মনে করিলেন, আশার লাঞ্ছনাতেই মহেন্দ্র চলিয়া গেছে। রাজলক্ষ্মী আশাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “মহেন্দ্র কাল রাত্রে চলিয়া গেল কেন।”

আশা মুখ নিচু করিয়া বলিল, “জানি না, মা।”

রাজলক্ষ্মী ভাবিলেন, এটাও অভিমানের কথা। বিরক্ত হইয়া কহিলেন, “তুমি জান না তো কে জানিবে। তাহাকে কিছু বলিয়াছিলে?”

0 Shares