চোখের বালি

আশা কেবলমাত্র বলিল, “না।”

রাজলক্ষ্মী বিশ্বাস করিলেন না। এ কি কখনো সম্ভব হয়।

জিজ্ঞাসা করিলেন, “কাল মহিন কখন গেল।”

আশা সংকুচিত হইয়া কহিল, “জানি না।”

রাজলক্ষ্মী অত্যন্ত রাগিয়া উঠিয়া কহিলেন, “তুমি কিছুই জান না! কচি খুকি! তোমার সব চালাকি।”

আশারই আচরণে ও স্বভাবদোষেই যে মহেন্দ্র গৃহত্যাগী হইয়াছে, এ মতও রাজলক্ষ্মী তীব্রস্বরে ঘোষণা করিয়া দিলেন। আশা নতমস্তকে সেই ভর্ৎসনা বহন করিয়া নিজের ঘরে গিয়া কাঁদিতে লাগিল। সে মনে মনে ভাবিল, “কেন যে আমাকে আমার স্বামী একদিন ভালোবাসিয়াছিলেন, তাহা আমি জানি না এবং কেমন করিয়া যে তাঁহার ভালোবাসা ফিরিয়া পাইব, তাহাও আমি বলিতে পারি না।’ যে লোক ভালোবাসে, তাহাকে কেমন করিয়া খুশি করিতে হয়, তাহা হৃদয় আপনি বলিয়া দেয়; কিন্তু যে ভালোবাসে না, তাহার মন কী করিয়া পাইতে হয়, আশা তাহার কী জানে। যে লোক অন্যকে ভালোবাসে, তাহার নিকট হইতে সোহাগ লইতে যাওয়ার মতো এমন নিরতিশয় লজ্জাকর চেষ্টা সে কেমন করিয়া করিবে।

সন্ধ্যাকালে বাড়ির দৈবজ্ঞ-ঠাকুর এবং তাঁহার ভগিনী আচার্য-ঠাকরুন আসিয়াছেন। ছেলের গ্রহশান্তির জন্য রাজলক্ষ্মী ইহাদিগকে ডাকিয়া পাঠাইয়াছিলেন। রাজলক্ষ্মী একবার বউমার কোষ্ঠী এবং হাত দেখিবার জন্য দৈবজ্ঞকে অনুরোধ করিলেন এবং সেই উপলক্ষে আশাকে উপস্থিত করিলেন। পরের কাছে নিজের দুর্ভাগ্য-আলোচনার সংকোচে একান্ত কুণ্ঠিত হইয়া আশা কোনোমতে তাহার হাত বাহির করিয়া বসিয়াছে, এমন সময় রাজলক্ষ্মী তাঁহার ঘরের পার্শ্বস্থ দীপহীন বারান্দা দিয়া মৃদু জুতার শব্দ পাইলেন–কে যেন গোপনে চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছে। রাজলক্ষ্মী ডাকিলেন, “কে ও।”

প্রথমে সাড়া পাইলেন না। তাহার পর আবার ডাকিলেন, “কে যায় গো।” তখন নিরুত্তর মহেন্দ্র ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিল।

আশা খুশি হইবে কি, মহেন্দ্রের লজ্জা দেখিয়া লজ্জায় তাহার হৃদয় ভরিয়া গেল। মহেন্দ্রকে এখন নিজের বাড়িতেও চোরের মতো প্রবেশ করিতে হয়। দৈবজ্ঞ এবং আচার্য-ঠাকরুন বসিয়া আছেন বলিয়া তাহার আরো লজ্জা হইল। সমস্ত পৃথিবীর কাছে নিজের স্বামীর জন্য যে লজ্জা, ইহাই আশার দুঃখের চেয়েও যেন বেশি হইয়া উঠিয়াছে। রাজলক্ষ্মী যখন মৃদুস্বরে বউকে বলিলেন, “বউমা, পার্বতীকে বলিয়া দাও, মহিনের খাবার গুছাইয়া আনে”, তখন আশা কহিল, “মা, আমিই আনিতেছি।” বাড়ির দাসদাসীদের দৃষ্টি হইতেও সে মহেন্দ্রকে ঢাকিয়া রাখিতে চায়।

এ দিকে আচার্য ও তাহার ভগিনীকে দেখিয়া মহেন্দ্র মনে মনে অত্যন্ত রাগ করিল। তাহার মাতা ও স্ত্রী দৈবসহায়ে তাহাকে বশ করিবার জন্য এই অশিক্ষিত মূঢ়দের সহিত নির্লজ্জভাবে ষড়যন্ত্র করিতেছে, ইহা মহেন্দ্রের কাছে অসহ্য বোধ হইল। ইহার উপর যখন আচার্য-ঠাকরুন অতিরিক্ত মধুমাখা স্নেহরসের সঞ্চার করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভালো আছ তো, বাবা”–তখন মহেন্দ্র আর বসিয়া থাকিতে পারিল না; কুশলপ্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়া কহিল, “মা, আমি একবার উপরে যাইতেছি।”

মা ভাবিলেন মহেন্দ্র বুঝি শয়নগৃহে বিরলে বধূর সঙ্গে কথাবার্তা কহিতে চায়। অত্যন্ত খুশি হইয়া তাড়াতাড়ি রন্ধনশালায় নিজে গিয়া আশাকে কহিলেন, “যাও, যাও, তুমি একবার শীঘ্র উপরে যাও, মহিনের কী বুঝি দরকার আছে।”

আশা দুরুদুরু বক্ষে সসংকোচ পদক্ষেপে উপরে গেল। শাশুড়ির কথায় সে মনে করিয়াছিল, মহেন্দ্র বুঝি তাহাকে ডাকিয়াছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে কোনোমতেই হঠাৎ ঢুকিতে পারিল না, ঢুকিবার পূর্বে আশা অন্ধকারে দ্বারের অন্তরালে মহেন্দ্রকে দেখিতে লাগিল।

মহেন্দ্র তখন অত্যন্ত শূন্যহৃদয়ে নীচের বিছানায় পড়িয়া তাকিয়ায় ঠেস দিয়া কড়িকাঠ পর্যালোচনা করিতেছিল। এই তো সেই মহেন্দ্র–সেই সবই, কিন্তু কী পরিবর্তন। এই ক্ষুদ্র শয়নঘরটিকে একদিন মহেন্দ্র স্বর্গ করিয়া তুলিয়াছিল–আজ কেন সেই আনন্দস্মৃতিতে-পবিত্র ঘরটিকে মহেন্দ্র অপমান করিতেছে। এত কষ্ট, এত বিরক্তি, এত চাঞ্চল্য যদি, তবে ও শয্যায় আর বসিয়ো না, মহেন্দ্র। এখানে আসিয়াও যদি মনে না পড়ে সেই-সমস্ত পরিপূর্ণ গভীর রাত্রি, সেই-সমস্ত সুনিবিড় মধ্যাহ্ন, আত্মহারা কর্মবিস্মৃত ঘনবর্ষার দিন, দক্ষিণবায়ুকম্পিত বসন্তের বিহ্বল সন্ধ্যা, সেই অনন্ত অসীম অসংখ্য অনির্বচনীয় কথাগুলি, তবে এ বাড়িতে অন্য অনেক ঘর আছে, কিন্তু এই ক্ষুদ্র ঘরটিতে আর এক মুহূর্তও নহে।

আশা অন্ধকারে দাঁড়াইয়া যতই মহেন্দ্রকে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিতে লাগিল ততই তাহার মনে হইতে লাগিল মহেন্দ্র এইমাত্র সেই বিনোদিনীর কাছ হইতে আসিতেছে; তাহার অঙ্গে সেই বিনোদিনীর স্পর্শ, তাহার চোখে সেই বিনোদিনীর মূর্তি, কানে সেই বিনোদিনীর কণ্ঠস্বর, মনে সেই বিনোদিনীর বাসনা একেবারে লিপ্ত জড়িত হইয়া আছে। এই মহেন্দ্রকে আশা কেমন করিয়া পবিত্র ভক্তি দিবে, কেমন করিয়া একাগ্রমনে বলিবে, “এসো, আমার অনন্যপরায়ণ হৃদয়ের মধ্যে এসো, আমার অটলনিষ্ঠ সতীপ্রেমের শুভ্র শতদলের উপর তোমার চরণ-দুখানি রাখো।’ সে তাহার মাসির উপদেশ, পুরাণের কথা, শাস্ত্রের অনুশাসন কিছুই মানিতে পারিল না–এই দাম্পত্যস্বর্গচ্যুত মহেন্দ্রকে সে আর মনের মধ্যে দেবতা বলিয়াঅনুভব করিল না। সে আজ বিনোদিনীর কলঙ্কপারাবারের মধ্যে তাহার হৃদয়দেবতাকে বিসর্জন দিল; সেই প্রেমশূন্য রাত্রির অন্ধকারে তাহার কানের মধ্যে, বুকের মধ্যে, মস্তিষ্কের মধ্যে, তাহার সর্বাঙ্গে রক্তস্রোতের মধ্যে, তাহার চারিদিকের সমস্ত সংসারে, তাহার আকাশের নক্ষত্রে, তাহার প্রাচীরবেষ্টিত নিভৃত ছাদটিতে, তাহার শয়নগৃহের পরিত্যক্ত বিরহশয্যাতলে একটি ভয়ানক গম্ভীর ব্যাকুলতার সঙ্গে বিসর্জনের বাদ্য বাজিতে লাগিল।

0 Shares