চোখের বালি

কথাটা যে কেবল খাপছাড়া শুনাইল তাহা নহে, আশাকে যেন মারিল। মূঢ় আশা যে শিক্ষিতা হইবার চেষ্টা করিতেছে, সেটা তাহার বড়ো গোপন কথা–আশা স্থির করিয়াছিল, এ কথাটা বড়োই হাস্যকর। তাহার এই শিক্ষালাভের সংকল্প যদি কাহারো হাস্যবিদ্রূপের লেশমাত্র আভাস হইতেও গোপন করিবার বিষয় হয়, তবে তাহা বিশেষরূপে মহেন্দ্রের। সেই মহেন্দ্র যখন এতদিন পরে প্রথম সম্ভাষণে হাসিয়া সেই কথাটারই অবতারণা করিল, তখন নিষ্ঠুরবেত্রাহত শিশুর কোমল দেহের মতো আশার সমস্ত মনটা সংকুচিত ব্যথিত হইতে লাগিল। সে আর কোনো উত্তর না দিয়া মুখ ফিরাইয়া টিপাইয়ের প্রান্ত ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

মহেন্দ্রও উচ্চারণমাত্র বুঝিয়াছিল, কথাটা ঠিক সংগত, ঠিক সময়োপযোগী হয় নাই–কিন্তু বর্তমান অবস্থায় উপযোগী কথাটা যে কী হইতে পারে তাহা মহেন্দ্র কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না। মাঝখানের এতবড়ো বিপ্লবের পরে পূর্বের ন্যায় কোনো সহজ কথা ঠিকমত শুনায় না, হৃদয়ও একেবারে মূক, কোনো নতুন কথা বলিবার জন্য সে প্রস্তুত নহে। মহেন্দ্র ভাবিল, “বিছানার ভিতরে ঢুকিয়া পড়িলে সেখানকার নিভৃত বেষ্টনের মধ্যে হয়তো কথা কওয়া সহজ হইবে।’ এই ভাবিয়া মহেন্দ্র আবার মশারির বহির্ভাগ কোঁচা দিয়া ঝাড়িতে লাগিল। নূতন অভিনেতা রঙ্গভূমিতে প্রবেশের পূর্বে যেমন উৎকণ্ঠার সঙ্গে নেপথ্যদ্বারে দাঁড়াইয়া নিজের অভিনেতব্য বিষয় মনে মনে আবৃত্তি করিয়া দেখিতে থাকে, মহেন্দ্র সেইরূপ মশারির সম্মুখে দাঁড়াইয়া মনে মনে তাহার বক্তব্য ও কর্তব্য আলোচনা করিতে লাগিল। এমন সময় অত্যন্ত মৃদু একটা শব্দ শুনিয়া মহেন্দ্র মুখ ফিরাইয়া দেখিল, আশা ঘরের মধ্যে নাই।

৪৩

পরদিন প্রাতে মহেন্দ্র মাকে বলিল, “মা, পড়াশুনার জন্য আমার একটি নিরিবিলি স্বতন্ত্র ঘর চাই। কাকীমা যে ঘরে থাকিতেন, সেই ঘরে আমি থাকিব।”

মা খুশি হইয়া উঠিলেন–“তবে তো মহিন বাড়িতেই থাকিবে। তবে তো বউমার সঙ্গে মিটমাট হইয়া গেছে। আমার এমন সোনার বউকে কি মহিন চিরদিন অনাদর করিতে পারে। এই লক্ষ্মীকে ছাড়িয়া কোথাকার সেই মায়াবিনী ডাইনিটাকে লইয়া কতদিনই বা মানুষ ভুলিয়া থাকিবে।’

মা তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তা বেশ তো মহিন।” বলিয়া তখনই চাবি বাহির করিয়া রুদ্ধ ঘর খুলিয়া ঝাড়াঝোড়ার ধুমধাম বাধাইয়া দিলেন। “বউ, ও বউ, বউ কোথায় গেল।” অনেক সন্ধানে বাড়ির এক কোণ হইতে সংকুচিতা বধূকে বাহির করিয়া আনা হইল। “একটা সাফ জাজিম বাহির করিয়া দাও; এ ঘরে টেবিল নাই, এখানে একটা টেবিল পাতিয়া দিতে হইবে; এ আলো তো এখানে চলিবে না, উপর হইতে ল্যাম্পটা পাঠাইয়া দাও।” এইরূপে উভয়ে মিলিয়া এই বাড়িটির রাজাধিরাজের জন্য অন্নপূর্ণার ঘরে বিস্তৃত রাজাসন প্রস্তুত করিয়া দিলেন। মহেন্দ্র সেবাকারিণীদের প্রতি ভ্রূক্ষেপমাত্র না করিয়া গম্ভীরমুখে খাতাপত্র বহি লইয়া ঘরে বসিল এবং সময়ের লেশমাত্র অপব্যয় না করিয়া তৎক্ষণাৎ পড়িতে আরম্ভ করিল।

সন্ধ্যাবেলায় আহারের পর মহেন্দ্র পুনরায় পড়িতে বসিয়া গেল। সে উপরে তাহার শয়নঘরে শুইবে কি নীচে শুইবে তাহা কেহ বুঝিতে পারিল না। রাজলক্ষ্মী বহুযত্নে আশাকে আড়ষ্ট পুতুলটির মতো সাজাইয়া কহিলেন, “যাও তো বউমা, মহিনকে জিজ্ঞাসা করিয়া এসো, তাহার বিছানা কি উপরে হইবে।”

এ প্রস্তাবে আশার পা কিছুতেই সরিল না, সে নীরবে নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। রুষ্ট রাজলক্ষ্মী তাহাকে তীব্র ভর্ৎসনা করিতে লাগিলেন। আশা বহুকষ্টে ধীরে ধীরে দ্বারের কাছে গেল, কিছুতেই আর অগ্রসর হইতে পারিল না। রাজলক্ষ্মী দূর হইতে বধূর এই ব্যবহার দেখিয়া বারান্দার প্রান্তে দাঁড়াইয়া ক্রুদ্ধ ইঙ্গিত করিতে লাগিলেন।

আশা মরিয়া হইয়া ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। মহেন্দ্র পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া বই হইতে মাথা না তুলিয়া কহিল, “এখনো আমার দেরি আছে–আবার কাল ভোরে উঠিয়া পড়িতে হইবে–আমি এইখানেই শুইব।”

কী লজ্জা। আশা কি মহেন্দ্রকে উপরের ঘরে শুইতে যাইবার জন্য সাধিতে আসিয়াছিল।

ঘর হইতে সে বাহির হইতেই রাজলক্ষ্মী বিরক্তির স্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী, হইল কী।”

আশা কহিল, “তিনি এখন পড়িতেছেন, নীচেই শুইবেন।” বলিয়া সে নিজের অপমানিত শয়নগৃহে আসিয়া প্রবেশ করিল। কোথাও তাহার সুখ নাই–সমস্ত পৃথিবী সর্বত্রই যেন মধ্যাহ্নের মরু ভূতলের মতো তপ্ত হইয়া উঠিয়াছে।

খানিক রাত্রে আশার শয়নগৃহের রুদ্ধদ্বারে ঘা পড়িল, “বউ, বউ, দরজা খোলো।”

আশা তাড়াতাড়ি দ্বার খুলিয়া দিল। রাজলক্ষ্মী তাঁহার হাঁপানি লইয়া সিঁড়িতে উঠিয়া কষ্টে নিশ্বাস লইতেছিলেন। ঘরে প্রবেশ করিয়াই তিনি বিছানায় বসিয়া পড়িলেন ও বাক্‌শক্তি ফিরিয়া আসিতেই ভাঙা গলায় কহিলেন, “বউ, তোমার রকম কী। উপরে আসিয়া দ্বার বন্ধ করিয়াছ যে। এখন কি এইরকম রাগারাগি করিবার সময়! এত দুঃখেও তোমার ঘটে বুদ্ধি আসিল না। যাও, নীচে যাও।”

আশা মৃদুস্বরে কহিল, “তিনি একলা থাকিবেন বলিয়াছেন।”

রাজলক্ষ্মী। একলা থাকিবে বলিলেই হইল। রাগের মুখে সে কী কথা বলিয়াছে, তাই শুনিয়া অমনি বাঁকিয়া বসিতে হইবে! এত অভিমানী হইলে চলে না। যাও,শীঘ্র যাও।

দুঃখের দিনে বধূর কাছে শাশুড়ির আর লজ্জা নাই। তাঁহার হাতে যে কিছু উপায় আছে, তাহাই দিয়া মহেন্দ্রকে কোনোমতে বাঁধিতেই হইবে।

0 Shares