চোখের বালি

আবেগের সহিত কথা কহিতে কহিতে রাজলক্ষ্মীর পুনরায় অত্যন্ত শ্বাসকষ্ট হইল। কতকটা সংবরণ করিয়া তিনি উঠিলেন। আশাও দ্বিরুক্তি না করিয়া তাঁহাকে ধরিয়া লইয়া নীচে চলিল। রাজলক্ষ্মীকে আশা তাঁহার শয়নঘরে বিছানায় বসাইয়া, তাকিয়াবালিশগুলি পিঠের কাছে ঠিক করিয়া দিতে লাগিল। রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “থাক্‌ বউমা, থাক্‌। সুধোকে ডাকিয়া দাও। তুমি যাও, আর দেরি করিয়ো না।”

আশা এবার আর দ্বিধামাত্র করিল না। শাশুড়ির ঘর হইতে বাহির হইয়া একেবারে মহেন্দ্রের ঘরে গিয়া উপস্থিত হইল। মহেন্দ্রের সম্মুখে টেবিলের উপর খোলা বই পড়িয়া আছে–সে টেবিলের উপর দু পা তুলিয়া দিয়া চৌকির উপর মাথা রাখিয়া একমনে কী ভাবিতেছিল। পশ্চাতে পদশব্দ শুনিয়া একেবারে চমকিয়া উঠিয়া ফিরিয়া তাকাইল। যেন কাহার ধ্যানে নিমগ্ন ছিল, হঠাৎ ভ্রম হইয়াছিল, সে-ই বুঝি আসিয়াছে। আশাকে দেখিয়া মহেন্দ্র সংযত হইয়া পা নামাইয়া খোলা বইটা কোলে টানিয়া লইল।

মহেন্দ্র আজ মনে মনে আশ্চর্য হইল। আজকাল তো আশা এমন অসংকোচেতাহার সম্মুখে আসে না–দৈবাৎ তাহাদের উভয়ের সাক্ষাৎ হইলে সে তখনই চলিয়া যায়। আজ এত রাত্রে এমন সহজে সে যে তাহার ঘরে আসিয়া প্রবেশ করিল, এ বড়ো বিস্ময়কর। মহেন্দ্র তাহার বই হইতে মুখ না তুলিয়াই বুঝিল, আশার আজ চলিয়া যাইবার লক্ষণ নহে। আশা মহেন্দ্রের সম্মুখে স্থিরভাবে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন মহেন্দ্র আর পড়িবার ভান করিতে পারিল না–মুখ তুলিয়া চাহিল। আশা সুস্পষ্ট স্বরে কহিল, “মার হাঁপানি বাড়িয়াছে, তুমি একবার তাঁহাকে দেখিলে ভালো হয়।”

মহেন্দ্র। তিনি কোথায় আছেন?

আশা। তাঁহার শোবার ঘরেই আছেন, ঘুমাইতে পারিতেছেন না।

মহেন্দ্র। তবে চলো, তাঁহাকে দেখিয়া আসি গে।

অনেক দিনের পরে আশার সঙ্গে এইটুকু কথা কহিয়া মহেন্দ্র যেন অনেকটা হালকা বোধ করিল। নীরবতা যেন দুর্ভেদ্য দুর্গপ্রাচীরের মতো স্ত্রীপুরুষের মাঝখানে কালো ছায়া ফেলিয়া দাঁড়াইয়া ছিল, মহেন্দ্রের তরফ হইতে তাহা ভাঙিবার কোনো অস্ত্র ছিল না–এমন সময় আশা স্বহস্তে কেল্লার একটি ছোটো দ্বার খুলিয়া দিল।

রাজলক্ষ্মীর দ্বারের বাহিরে আশা দাঁড়াইয়া রহিল, মহেন্দ্র ঘরে প্রবেশ করিল। মহেন্দ্রকে অসময়ে ঘরে আসিতে দেখিয়া রাজলক্ষ্মী ভীত হইলেন, ভাবিলেন, বুঝি বা আশার সঙ্গে রাগারাগি করিয়া আবার সে বিদায় লইতে আসিয়াছে। কহিলেন, “মহিন, এখনো ঘুমাস নাই?”

মহেন্দ্র কহিল, “মা, তোমার সেই হাঁপানি কি বাড়িয়াছে।”

এতদিন পরে এই প্রশ্ন শুনিয়া মার মনে বড়ো অভিমান জন্মিল। বুঝিলেন, বউ গিয়া বলাতেই আজ মহিন মার খবর লইতে আসিয়াছে। এই অভিমানের আবেগে তাঁহার বক্ষ আরো আন্দোলিত হইয়া উঠিল–কষ্টে বাক্য উচ্চারণ করিয়া বলিলেন, “যা, তুই শুতে যা। আমার ও কিছুই না।”

মহেন্দ্র। না মা, একবার পরীক্ষা করিয়া দেখা ভালো, এ ব্যামো উপেক্ষা করিবার জিনিস নহে।

মহেন্দ্র জানিত, তাহার মাতার হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা আছে, এই কারণে এবং মাতার মুখশ্রীর লক্ষণ দেখিয়া সে উদ্‌বেগ অনুভব করিল।

মা কহিলেন, “পরীক্ষা করিবার দরকার নাই, আমার এ ব্যামো সারিবার নহে।”

মহেন্দ্র কহিল, “আচ্ছা, আজ রাত্রের মতো একটা ঘুমের ওষুধ আনাইয়া দিতেছি, কাল ভালো করিয়া দেখা যাইবে।”

রাজলক্ষ্মী। ঢের ওষুধ খাইয়াছি, ওষুধে আমার কিছু হয় না। যাও মহিন, অনেক রাত হইয়াছে, তুমি ঘুমাইতে যাও।

মহেন্দ্র। তুমি একটু সুস্থ হইলেই আমি যাইব।

তখন অভিমানিনী রাজলক্ষ্মী দ্বারের অন্তরালবর্তিনী বধূকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, “বউ, কেন তুমি এই রাত্রে মহেন্দ্রকে বিরক্ত করিবার জন্য এখানে আনিয়াছ।” বলিতে বলিতে তাঁহার শ্বাসকষ্ট আরো বাড়িয়া উঠিল।

তখন আশা ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া মৃদু অথচ দৃঢ়স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “যাও, তুমি শুইতে যাও, আমি মার কাছে থাকিব।”

মহেন্দ্র আশাকে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া কহিল, “আমি একটা ওষুধ আনাইতে পাঠাইলাম। শিশিতে দুই দাগ থাকিবে–এক দাগ খাওয়াইয়া যদি ঘুম না আসে তবে এক ঘণ্টা পরে আর-এক দাগ খাওয়াইয়া দিয়ো। রাত্রে বাড়িলে আমাকে খবর দিতে ভুলিয়ো না।”

এই বলিয়া মহেন্দ্র নিজের ঘরে ফিরিয়া গেল। আশা আজ তাহার কাছে যে-মূর্তিতে দেখা দিল, এ যেন মহেন্দ্রের পক্ষে নূতন। এ আশার মধ্যে সংকোচ নাই, দীনতা নাই, এই আশা নিজের অধিকারের মধ্যে নিজে অধিষ্ঠিত, সেটুকুর জন্য মহেন্দ্রের নিকট সে ভিক্ষাপ্রার্থিনী নহে। নিজের স্ত্রীকে মহেন্দ্র উপেক্ষা করিয়াছে, কিন্তু বাড়ির বধূর প্রতি তাহার সম্ভ্রম জন্মিল।

আশা তাঁহার প্রতি যত্নবশত মহেন্দ্রকে ডাকিয়া আনিয়াছে, ইহাতে রাজলক্ষ্মী মনে মনে খুশি হইলেন। মুখে বলিলেন, “বউমা, তোমাকে শুতে পাঠাইলাম, তুমি আবার মহেন্দ্রকে টানিয়া আনিলে কেন।”

আশা তাহার উত্তর না দিয়া পাখা-হাতে তাঁহার পশ্চাতে বসিয়া বাতাস করিতে লাগিল।

রাজলক্ষ্মী কহিলেন, “যাও বউমা, শুতে যাও।”

আশা মৃদুস্বরে কহিল, “আমাকে এইখানে বসিতে বলিয়া গেছেন।” আশা জানিত, মহেন্দ্র মাতার সেবায় তাহাকে নিয়োগ করিয়া গেছে, এ খবরে রাজলক্ষ্মী খুশি হইবেন।

৪৪

রাজলক্ষ্মী যখন স্পষ্টই দেখিলেন, আশা মহেন্দ্রের মন বাঁধিতে পারিতেছে না, তখন তাঁহার মনে হইল, “অন্তত আমার ব্যামো উপলক্ষ করিয়াও যদি মহেন্দ্রকে থাকিতে হয় সেও ভালো।’ তাঁহার ভয় হইতে লাগিল, পাছে তাঁহার অসুখ একেবারে সারিয়া যায়। আশাকে ভাঁড়াইয়া ওষুধ তিনি ফেলিয়া দিতে আরম্ভ করিলেন।

0 Shares