চোখের বালি

রাজলক্ষ্মী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “মহিনরা তো এখন শুইতে গেছে, রাত্রে তাহাকে একবার আনিলে কি ক্ষতি আছে।”

বিহারী কহিল, “মা, সে তো এই বাড়িরই বাহির-ঘরে লুকাইয়া বসিয়া আছে। তাহাকে আজ সমস্ত দিন জলবিন্দু পর্যন্ত মুখে দেওয়াইতে পারি নাই। সে পণ করিয়াছে, যতক্ষণ তুমি তাহাকে ডাকিয়া না মাপ করিবে ততক্ষণ সে জলস্পর্শ করিবে না।”

রাজলক্ষ্মী ব্যস্ত হইয়া কহিলেন, “সমস্ত দিন উপবাস করিয়া আছে! আহা, তাহাকে ডাক্‌, ডাক্‌!”

বিনোদিনী ধীরে ধীরে রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিতেই তিনি বলিয়া উঠিলেন, “ছি ছি বউ, তুমি করিয়াছ কি। আজ সমস্ত দিন উপোস করিয়া আছ? যাও যাও, আগে খাইয়া লও, তাহার পরে কথা হইবে।”

বিনোদিনী রাজলক্ষ্মীর পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিয়া কহিল, “আগে তুমি পাপিষ্ঠাকে মাপ করো, পিসিমা, তবে আমি খাইব।”

রাজলক্ষ্মী। মাপ করিয়াছি বাছা, মাপ করিয়াছি, আমার এখন কাহারো উপর আর রাগ নাই।– বিনোদিনীর ডান হাত ধরিয়া তিনি কহিলেন, “বউ, তোমা হইতে কাহারো মন্দ না হউক, তুমিও ভালো থাকো।”

বিনোদিনী। তোমার আশীর্বাদ মিথ্যা হইবে না, পিসিমা। আমি তোমার পা ছুঁইয়া বলিতেছি আমা হইতে এ সংসারের মন্দ হইবে না।

অন্নপূর্ণাকে বিনোদিনী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রণাম করিয়া খাইতে গেল। খাইয়া আসিলে পর রাজলক্ষ্মী তাহার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “বউ, এখন তবে তুমি চলিলে?”

বিনোদিনী। পিসিমা, আমি তোমার সেবা করিব। ঈশ্বর সাক্ষী, আমা হইতে তুমি কোনো অনিষ্ট আশঙ্কা করিয়ো না।

রাজলক্ষ্মী বিহারীর মুখের দিকে চাহিলেন। বিহারী একটু চিন্তা করিয়া কহিল, “বোঠান থাকুন মা, তাহাতে ক্ষতি হইবে না।”

রাত্রে বিহারী, বিনোদিনী এবং অন্নপূর্ণা তিনজনে মিলিয়া রাজলক্ষ্মীর শুশ্রূষা করিলেন।

এ দিকে আশা সমস্ত রাত্রি রাজলক্ষ্মীর ঘরে আসে নাই বলিয়া লজ্জায় অত্যন্ত প্রত্যুষে উঠিয়াছে। মহেন্দ্রকে বিছানায় সুপ্ত অবস্থায় রাখিয়া তাড়াতাড়ি মুখ ধুইয়া কাপড় ছাড়িয়া প্রস্তুত হইয়া আসিল। তখনো অন্ধকার একেবারে যায় নাই। রাজলক্ষ্মীর দ্বারের কাছে আসিয়া যাহা দেখিল, তাহাতে আশা অবাক হইয়া গেল। ভাবিল , “এ কি স্বপ্ন।’

বিনোদিনী একটি স্পিরিট ল্যাম্প জ্বালিয়া জল গরম করিতেছে। বিহারী রাত্রে ঘুমাইতে পায় নাই, তাহার জন্য চা তৈরি হইবে।

আশাকে দেখিয়া বিনোদিনী উঠিয়া দাঁড়াইল। কহিল, “আজ আমি আমার সমস্ত অপরাধ লইয়া তোমার আশ্রয় গ্রহণ করিলাম– আর কেহ আমাকে দূর করিতে পারিবে না– কিন্তু তুমি যদি বল “যাও’ তো আমাকে এখনই যাইতে হইবে।”

আশা কোনো উত্তর করিতে পারিল না– তাহার মন কী বলিতেছে, তাও সে যেন ভালো করিয়া বুঝিতে পারিল না, অভিভূত হইয়া রহিল।

বিনোদিনী কহিল, “আমাকে কোনোদিন তুমি মাপ করিতে পারিবে না– সে চেষ্টাও করিয়ো না। কিন্তু আমাকে আর ভয় করিয়ো না। যে কয়দিন পিসিমার দরকার হইবে, সেই কটা দিন আমাকে একটুখানি কাজ করিতে দাও, তার পরে আমি চলিয়া যাইব।”

কাল রাজলক্ষ্মী যখন আশার হাত লইয়া মহেন্দ্রের হাতে দিলেন, তখন আশা তাহার মন হইতে সমস্ত অভিমান মুছিয়া ফেলিয়া সম্পূর্ণভাবে মহেন্দ্রের কাছে আত্মসমর্পন করিয়াছিল। আজ বিনোদিনীকে সম্মুখে দেখিয়া তাহার খণ্ডিত প্রেমের দাহ শান্তি মানিল না। ইহাকে মহেন্দ্র একদিন ভালোবাসিয়াছিল, ইহাকে এখনো হয়তো মনে মনে ভালোবাসে– এ কথা তাহার বুকের ভিতরে ঢেউয়ের মতো ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। কিছুক্ষণ পরেই মহেন্দ্র জাগিয়া উঠিবে, বিনোদিনীকে দেখিবে– কী জানি কী চক্ষে দেখিবে। কাল রাত্রে আশা তাহার সমস্ত সংসারকে নিষ্কন্টক দেখিয়াছিল– আজ প্রত্যুষে উঠিয়াই দেখিল, কাঁটাগাছ তাহার ঘরের প্রাঙ্গণেই। সংসারে সুখের স্থানই সবচেয়ে সংকীর্ণ– কোথাও তাহাকে সম্পূর্ণ নির্বিঘ্নে রাখিবার অবকাশ নাই।

হৃদয়ের ভার লইয়া আশা রাজলক্ষ্মীর ঘরে প্রবেশ করিল, এবং অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে কহিল, “মাসিমা, তুমি সমস্ত রাত বসিয়া আছ– যাও, শুতে যাও।” অন্নপূর্ণা আশার মুখের দিকে একবার ভালো করিয়া চাহিয়া দেখিলেন। তাহার পরে শুইতে না গিয়া আশাকে নিজের ঘরে লইয়া গেলেন। কহিলেন, “চুনি, যদি সুখী হইতে চাস, তবে সব কথা মনে রাখিস নে। অন্যকে দোষী করিয়া যেটুকু সুখ, দোষ মনে রাখিবার দুঃখ তাহার চেয়ে ঢের বেশি।”

আশা কহিল, “মাসিমা, আমি মনে কিছু পুষিয়া রাখিতে চাই না, আমি ভুলিতেই চাই, কিন্তু ভুলিতে দেয় না যে।”

অন্নপূর্ণা। বাছা, তুই ঠিক বলিয়াছিস– উপদেশ দেওয়া সহজ, উপায় বলিয়া দেওয়াই শক্ত। তবু আমি তোকে একটা উপায় বলিয়া দিতেছি। যেন ভুলিয়াছিস এই ভাবটি অন্তত বাহিরে প্রাণপণে রক্ষা করিতে হইবে–আগে বাহিরে ভুলিতে আরম্ভ করিস, তাহা হইলে ভিতরেও ভুলিবি। এ কথা মনে রাখিস চুনি, তুই যদি না ভুলিস, তবে অন্যকেও স্মরণ করাইয়া রাখিবি! তুই নিজের ইচ্ছায় না পারিস, আমি তোকে আজ্ঞা করিতেছি, তুই বিনোদিনীর সঙ্গে এমন ব্যবহার কর্‌, যেন সে কখনো তোর কোনো অনিষ্ট করে নাই এবং তাহার দ্বারা তোর অনিষ্টের কোনো আশঙ্কা নাই।

আশা নম্রমুখে কহিল, “কী করিতে হইবে বলো।”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “বিনোদিনী এখন বিহারীর জন্য চা তৈরি করিতেছে। তুই দুধ-চিনি-পেয়ালা সমস্ত লইয়া যা– দুইজনে মিলিয়া কাজ কর্‌।”

0 Shares