চোখের বালি

আশা আদেশ পালনের জন্য উঠিল। অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এটা সহজ– কিন্তু আমার আর-একটি কথা আছে, সেটা আরো শক্ত– সেইটে তোকে পালন করিতেই হইবে। মাঝে মাঝে মহেন্দ্রের সঙ্গে বিনোদিনীর দেখা হইবেই, তখন তোর মনে কী হইবে, তাহা আমি জানি– সে-সময় তুই গোপন কটাক্ষেও মহেন্দ্রের ভাব কিংবা বিনোদিনীর ভাব দেখিবার চেষ্টামাত্রও করিস নে। বুক ফাটিয়া গেলেও তোকে অবিচলিত থাকিতে হইবে। মহেন্দ্র ইহা জানিবে যে, তুই সন্দেহ করিস না, শোক করিস না, তোর মনে ভয় নাই, চিন্তা নাই– জোড় ভাঙিবার পূর্বে যেমন ছিল, জোড় লাগিয়া আবার ঠিক তেমনই হইয়াছে– ভাঙনের দাগটুকুও মিলাইয়া গেছে। মহেন্দ্র কি আর-কেহ তোর মুখ দেখিয়া নিজেকে অপরাধী বলিয়া মনে করিবে না। চুনি, ইহা আমার অনুরোধ বা উপদেশ নহে, ইহা তোর মাসিমার আদেশ। আমি যখন কাশী চলিয়া যাইব, আমার এই কথাটি একদিনের জন্যও ভুলিস নে।”

আশা চায়ের পেয়ালা প্রভৃতি লইয়া বিনোদিনীর কাছে উপস্থিত হইল। কহিল, “জল কি গরম হইয়াছে। আমি চায়ের দুধ আনিয়াছি।”

বিনোদিনী আশ্চর্য হইয়া আশার মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “বিহারী-ঠাকুরপো বারান্দায় বসিয়া আছেন, চা তুমি তাঁহার কাছে পাঠাইয়া দাও, আমি ততক্ষণ পিসিমার জন্য মুখ ধুইবার বন্দোবস্ত করিয়া রাখি। তিনি বোধ হয় এখনই উঠিবেন।”

বিনোদিনী, চা লইয়া বিহারীর কাছে গেল না। বিহারী ভালোবাসা স্বীকার করিয়া তাহাকে যে অধিকার দিয়াছে, সেই অধিকার স্বেচ্ছামতে খাটাইতে তাহার সংকোচ বোধ হইতে লাগিল। অধিকারলাভের যে মর্যাদা আছে, সেই মর্যাদা রক্ষা করিতে হইলে অধিকারপ্রয়োগকে সংযত করিতে হয়। যতটা পাওয়া যায় ততটা লইয়া টানাটানি করা কাঙালকেই শোভা পায়– ভোগকে খর্ব করিলেই সম্পদের যথার্থ গৌরব। এখন, বিহারী তাহাকে নিজে না ডাকিলে, কোনো-একটা উপলক্ষ করিয়া বিনোদিনী তাহার কাছে আর যাইতে পারে না।

বলিতে-বলিতেই মহেন্দ্র আসিয়া উপস্থিত হইল। আশার বুকের ভিতরটা যদিও ধড়াস করিয়া উঠিল, তবু সে আপনাকে সংবরণ করিয়া লইয়া স্বাভাবিক স্বরে মহেন্দ্রকে কহিল, “তুমি এত ভোরে উঠিলে যে? পাছে আলো লাগিয়া তোমার ঘুম ভাঙে তাই আমি জানালা-দরজা সব বন্ধ করিয়া আসিয়াছি।”

বিনোদিনীর সম্মুখেই আশাকে এইরূপ সহজভাবে কথা কহিতে শুনিয়া মহেন্দ্রের বুকের একটা পাথর যেন নামিয়া গেল। সে আনন্দচিত্তে কহিল, “মা, কেমন আছেন, তাই দেখিতে আসিয়াছি– মা কি এখনো ঘুমাইতেছেন।”

আশা কহিল, “হাঁ, তিনি ঘুমাইতেছেন, এখন তুমি যাইয়ো না। বিহারী-ঠাকুরপো বলিয়াছেন, তিনি আজ অনেকটা ভালো আছেন। অনেক দিন পরে কাল তিনি সমস্ত রাত ভালো করিয়া ঘুমাইয়াছেন।”

মহেন্দ্র নিশ্চিন্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কাকীমা কোথায়।”

আশা তাঁহার ঘর দেখাইয়া দিল।

আশার এই দৃঢ়তা ও সংযম দেখিয়া বিনোদিনীও আশ্চর্য হইয়া গেল।

মহেন্দ্র ডাকিল, “কাকীমা!”

অন্নপূর্ণা যদিও ভোরে স্নান করিয়া লইয়া এখন পূজায় বসিবেন স্থির করিয়াছিলেন তবুও তিনি কহিলেন, “আয়, মহিন, আয়।”

মহেন্দ্র তাঁহাকে প্রণাম করিয়া কহিল, “কাকীমা, আমি পাপিষ্ঠ, তোমাদের কাছে আসিতে আমার লজ্জা করে।”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “ছি ছি, ও কথা বলিস নে মহিন– ছেলে ধুলা লইয়াও মার কোলে আসিয়া বসে।”

মহেন্দ্র। কিন্তু আমার এ ধুলা কিছুতেই মুছিবে না কাকীমা।

অন্নপূর্ণা। দুই-একবার ঝাড়িলেই ঝরিয়া যাইবে। মহিন, ভালোই হইয়াছে। নিজেকে ভালো বলিয়া তোর অহংকার ছিল, নিজের ‘পরে বিশ্বাস তোর বড়ো বেশি ছিল, পাপের ঝড়ে তোর সেই গর্বটুকুই ভাঙ্গিয়া দিয়াছে, আর কোনো অনিষ্ট করে নাই।

মহেন্দ্র। কাকীমা, এবার তোমাকে আর ছাড়িয়া দিব না, তুমি গিয়াই আমার এই দুর্গতি হইয়াছে।

অন্নপূর্ণা। আমি থাকিয়া যে-দুর্গতি ঠেকাইয়া রাখিতাম, সে-দুর্গতি একবার ঘটিয়া যাওয়াই ভালো। এখন আর তোর আমাকে কোনো দরকার হইবে না।

দরজার কাছে আবার ডাক পড়িল, “কাকীমা, আহ্নিকে বসিয়াছ নাকি।”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “না, তুই আয়।”

বিহারী ঘরে প্রবেশ করিল। এত সকালে মহেন্দ্রকে জাগ্রত দেখিয়া কহিল, “মহিনদা, আজ তোমার জীবনে এই বোধ হয় প্রথম সূর্যোদয় দেখিলে!”

মহেন্দ্র কহিল, “হাঁ বিহারী, আজ আমার জীবনে প্রথম সূর্যোদয়, বিহারীর বোধ হয় কাকীমার সঙ্গে কোনো পরামর্শ আছে– আমি যাই।”

বিহারী হাসিয়া কহিল, “তোমাকেও নাহয় ক্যাবিনেটের মিনিস্টার করিয়া লওয়া গেল। তোমার কাছে আমি তো কখনো কিছু গোপন করি নাই– যদি আপত্তি না কর, আজও গোপন করিব না।”

মহেন্দ্র। আমি আপত্তি করিব! তবে আর দাবি করিতে পারি না বটে। তুমি যদি আমার কাছে কিছু গোপন না কর, তবে আমিও আমার প্রতি আবার শ্রদ্ধা করিতে পারিব।

আজকাল মহেন্দ্রের সম্মুখে সকল কথা অসংকোচে বলা কঠিন। বিহারীর মুখ বাধিয়া আসিল, তবু সে জোর করিয়া বলিল, “বিনোদিনীকে বিবাহ করিব, এমন-একটা কথা উঠিয়াছিল, কাকীমার সঙ্গে সেই সম্বন্ধে আমি কথাবার্তা শেষ করিতে আসিয়াছি।”

মহেন্দ্র একান্ত সংকুচিত হইয়া উঠিল। অন্নপূর্ণা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “এ আবার কী কথা বিহারী।”

মহেন্দ্র প্রবল শক্তি প্রয়োগ করিয়া সংকোচ দূর করিল। কহিল, “বিহারী, এ বিবাহের কোনো প্রয়োজন নাই।”

অন্নপূর্ণা কহিলেন, “এ বিবাহের প্রস্তাবে কি বিনোদিনীর কোনো যোগ আছে।”

0 Shares