চিঠি খোলবার আগে অনেক দিন পরে আবার বের করলে সেই ফোটোগ্রাফখানা। টেবিলের উপর রেখে দিলে। জানে ঐ ছবিটা দেখলে শশাঙ্ক খুব বিদ্রূপ করবে। তবু ঊর্মি কিছুতেই কুণ্ঠিত হবে না তার বিদ্রূপে; এই তার প্রায়শ্চিত্ত। নীরদের সঙ্গে ওর বিবাহ হবে এই প্রসঙ্গটা দিদিদের বাড়িতে ও চাপা দিত। অন্যেরাও তুলত না; কেননা এ প্রসঙ্গটা ওখানকার সকলের অপ্রিয়। আজ হাত মুঠো করে ঊর্মি স্থির করলে–ওর সকল ব্যবহারেই এই সংবাদটা জোরের সঙ্গে ঘোষণা করবে। কিছুদিন থেকে লুকিয়ে রেখেছিল এন্গেজমেণ্ট্ আংটি। সেটা বের করে পরলে। আংটিটা নিতান্ত কম দামের–নীরদ আপন অনেস্ট্ গরিবিয়ানার গর্বের দ্বারাই ঐ সস্তা আংটির দাম হীরের চেয়ে বেশি বাড়িয়ে দিয়েছিল। ভাবখানা এই যে, “আংটির দামেই আমার দাম নয়, আমার দামেই আংটির দাম।’
নিজেকে যথাসাধ্য শোধন করে নিয়ে ঊর্মি অতি ধীরে লেফাফাটা খুললে।
চিঠিখানা পড়ে হঠাৎ লাফিয়ে উঠল। ইচ্ছা করল নাচতে, কিন্তু নাচ ওর অভ্যাস নেই। সেতারটা ছিল বিছানার উপর, সেটা তুলে নিয়ে সুর না বেঁধেই ঝনাঝন ঝংকার দিয়ে যা-তা বাজাতে লাগল।
ঠিক এমন সময়ে শশাঙ্ক ঘরে ঢুকে জিজ্ঞাসা করলে, “ব্যাপারখানা কী। বিয়ের দিন স্থির হয়ে গেল বুঝি?”
“হাঁ শশাঙ্কদা, স্থির হয়ে গেছে।”
“কিছুতেই নড়চড় হবে না?”
“কিছুতেই না।”
“তা হলে এইবেলা সানাই বায়না দিই, আর ভীমনাগের সন্দেশ?”
“তোমাকে কোনো চেষ্টা করতে হবে না।”
“নিজেই সব করবে? ধন্য বীরাঙ্গনা। আর, কনেকে আশীর্বাদ?”
“সে আশীর্বাদের টাকাটা আমার নিজের পকেট থেকেই গেছে।”
“মাছের তেলেই মাছভাজা? ভালো বোঝা গেল না।’
“এই নাও, বুঝে দেখো।”
বলে চিঠিখানা ওর হাতে দিলে।
পড়ে শশাঙ্গ হো হো করে হেসে উঠল।
লিখছে : যে রিসার্চের দুরূহ কাজে নীরদ আত্মনিবেদন করতে চায় ভারতবর্ষে তা সম্ভব নয়। সেইজন্যেই ওর জীবনে আর-একটা মস্ত স্যাক্রিফাইস মেনে নিতে হল। ঊর্মির সঙ্গে বিবাহের সম্বন্ধ বিচ্ছিন্ন না করলে উপায় নেই। একজন য়ুরোপীয় মহিলা ওকে বিবাহ করে ওর কাজে আত্মদান করতে সম্মত। কিন্তু কাজটা সেই একই, ভারতবর্ষেই করা হোক আর এখানেই। রাজারামবাবু যে কাজের জন্য অর্থ দিতে চেয়েছিলেন তার কিয়দংশ সেখানে নিযুক্ত করলে অন্যায় হবে না। তাতে মৃতব্যক্তির ‘পরে সম্মান করাই হবে।
শশাঙ্ক বললে, “জীবিত ব্যক্তিটাকে কিছু কিছু দিয়ে যদি সেই দূরদেশেই দীর্ঘকাল জিইয়ে রাখতে পার তো মন্দ হয় না। টাকা বন্ধ করলে পাছে খিদের জ্বালায় মরিয়া হয়ে এখানে দৌড়ে আসে এই ভয় আছে।”
ঊর্মি হেসে বললে, “সে ভয় যদি তোমার মনে থাকে টাকা তুমিই দিয়ো, আমি এক পয়সাও দেব না।”
শশাঙ্ক বললে, “আবার তো মন বদল হবে না? মানিনীর অভিমান তো অটল থাকবে?”
“বদল হলে তোমার তাতে কী শশাঙ্কদা!”
“প্রশ্নের সত্য উত্তর দিলে অহংকার বেড়ে যাবে, অতএব তোমার হিতের জন্যে চুপ করে রইলুম। কিন্তু ভাবছি, লোকটার গণ্ডদেশ তো কম নয়, ইংরেজিতে যাকে বলে চীক্।”
ঊর্মির মনের মধ্যে থেকে প্রকাণ্ড একটা ভার নেমে গেল–বহু দিনের ভার। মুক্তির আনন্দে ও কী যে করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। ওর সেই কাজের ফর্দটা ছিঁড়ে ফেলে দিলে। গলিতে ভিক্ষুক দাঁড়িয়ে ভিক্ষা চাইছিল, জানলা থেকে আংটিটা ছুঁড়ে ফেললে তার দিকে।
জিজ্ঞাসা করলে, “এই পেন্সিলের দাগ দেওয়া মোটা বইগুলো কি কোনো হকার কিনবে।”
“নাই যদি কেনে, তার ফলাফলটা কী আগে শুনি।”
“যদি ওর মধ্যে সাবেক কালের ভূতটা বাসা করে, মাঝে মাঝে অর্ধেক রাত্রে তর্জনী তুলে আমার বিছানার কাছে এসে দাঁড়ায়।
“সে আশঙ্কা যদি থাকে হকারের অপেক্ষা করব না, আমি নিজেই কিনব।”
“কিনে কী করবে।”
“হিন্দুশাস্ত্রমতে অন্ত্যেষ্টিসৎকার। গয়া পর্যন্ত যেতে রাজি, তাতে যদি তোমার মন সান্ত্বনা পায়।”
“না, অতটা বাড়াবাড়ি সইবে না।”
“আচ্ছা, আমার লাইব্রেরির কোণে পিরামিড বানিয়ে ওদের মামি করে রেখে দেব।”
“আজ কিন্তু তুমি কাজে বেরোতে পাবে না।”
“সমস্ত দিন?”
“সমস্ত দিনই।”
“কী করতে হবে।”
“মোটরে করে উধাও হয়ে যাব।”
“দিদির কাছে ছুটি নিয়ে এসো গে।”
“না, ফিরে এসে দিদিকে বলব, তখন খুব বকুনি খাব। সে বকুনি সইবে।”
“আচ্ছা, আমিও তোমার দিদির বকুনি হজম করতে রাজি। টায়ার যদি ফাটে দুঃখিত হব না। ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইল বেগে দুটো-চারটে মানুষ চাপা দিয়ে একেবারে জেলখানা পর্যন্ত পৌঁছতে আপত্তি নেই। কিন্তু তিন সত্যি দাও যে, মোটর-রথযাত্রা সাঙ্গ করে আমাদেরই বাড়িতে তুমি ফিরে আসবে।”
“আসব, আসব, আসব।”
মোটর-যাত্রার শেষে ভবানীপুরের বাড়িতে দুজন এল, কিন্তু ঘণ্টায় পঁয়তাল্লিশ মাইলের বেগ রক্ত থেকে এখনো কিছুতেই থামতে চায় না। সংসারের সমস্ত দাবি সমস্ত ভয়লজ্জা এই বেগের কাছে বিলুপ্ত হয়ে গেল।
কয়দিন শশাঙ্কের সব কাজ গেল ঘুলিয়ে। মনের ভিতরে ভিতরে সে বুঝেছে যে, এটা ভালো হচ্ছে না। কাজের ক্ষতি খুব গুরুতর হওয়াও অসম্ভব নয়। রাত্রে বিছনায়ায় শুয়ে শুয়ে দুর্ভাবনায় দুঃসম্ভাবনাকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে দেখে। কিন্তু পরের দিনে আবার সে স্বাধিকারপ্রমত্ত, মেঘদূতের যক্ষের মতন। মদ একবার খেলে তার পরিতাপ ঢাকতে আবার খেতে হয়।
শশাঙ্ক