নৌকা ডুবি

কমলার মনের মধ্যে একটা আন্দোলন উপস্থিত হইল। সে ভাবিতে লাগিল, “হেমনলিনীর আমাকে কেমন লাগিবে কে জানে।’

এই হেমনলিনী এক দিন এই ঘরের বধূ হইয়া আসিবে, কর্ত্রী হইয়া উঠিবে–ইহার সুদৃষ্টিকে কমলা উপেক্ষা করিতে পারে না। এ বাড়ির গৃহিণীপদ তাহারই ছিল, কিন্তু সে কথা সে মনেও আনিতে চায় না–ঈর্ষাকে সে কোনোমতেই অন্তরে স্থান দিবে না। তাহার কোনো দাবি নাই। তাই হেমনলিনীর সঙ্গে যাইবার সময় তাহার পা কাঁপিয়া যাইতে লাগিল।

হেমনলিনী আস্তে আস্তে কমলাকে কহিল, “তোমার সব কথা আমি মা’র কাছে শুনিয়াছি। শুনিয়া বড়ো কষ্ট হইল। তুমি আমাকে তোমার বোনের মতো দেখিয়ো ভাই। তোমার কি বোন কেহ আছে?”

কমলা হেমনলিনীর সস্নেহ সকরুণ কণ্ঠস্বরে আশ্বস্ত হইয়া কহিল, “আমার আপন বোন কেহ নাই, আমার একটি খুড়তুতো বোন আছে।”

হেমনলিনী কহিল, “ভাই, আমার বোন কেহ নাই। আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার মা মারা গেছেন। কতবার কত সুখদুঃখের সময় ভাবিয়াছি, মা তো নাই, তবু যদি আমার একটি বোন থাকিত! ছেলেবেলা হইতে সব কথা কেবল মনের মধ্যেই চাপিয়া রাখিতে হইয়াছে, শেষকালে এমন অভ্যাস হইয়া গেছে যে, আজ মন খুলিয়া কোনো কথা বলিতেই পারি না। লোকে মনে করে, আমার ভারি দেমাক–কিন্তু তুমি ভাই, এমন কথা কখনো মনে করিয়ো না। আমার মন যে বোবা হইয়া গেছে।”

কমলার মন হইতে সমস্ত বাধা কাটিয়া গেল; সে কহিল, “দিদি, আমাকে কি তোমার ভালো লাগিবে? আমাকে তো তুমি জান, আমি ভারি মূর্খ।”

হেমনলিনী হাসিয়া কহিল, “আমাকে যখন তুমি ভালো করিয়া জানিবে, দেখিবে আমিও ঘোর মূর্খ। আমি কেবল গোটাকতক বই পড়িয়া মুখস্থ করিয়াছি, আর কিছুই জানি না। তাই আমি তোমাকে বলি, যদি আমার এ বাড়িতে আসা হয় তুমি আমাকে কখনো ছাড়িয়ো না ভাই! কোনোদিন সংসারের ভার আমার একলার হাতে পড়িয়াছে মনে করিলে আমার ভয় হয়।”

কমলা শিশুর মতো সরলচিত্তে কহিল, “ভার তুমি সমস্ত আমার উপর দিয়ো। আমি ছেলেবেলা হইতে কাজ করিয়া আসিয়াছি, আমি কোনো ভার লইতে ভয় করি না। আমরা দুই বোনে মিলিয়া সংসার চালাইব, তুমি তাঁহাকে সুখে রাখিবে, আমি তোমাদের সেবা করিব।”

হেমনলিনী কহিল, “আচ্ছা ভাই, তোমার স্বামীকে তো তুমি ভালো করিয়া দেখ নাই, তাঁহাকে তোমার মনে পড়ে?”

কমলা কথার স্পষ্ট উত্তর না দিয়া কহিল, “স্বামীকে যে মনে করিতে হয় তাহা আমি জানিতাম না দিদি! খুড়ার বাড়িতে যখন আসিলাম তখন আমার খুড়তুতো বোন শৈলদিদির সঙ্গে আমার ভালো করিয়া পরিচয় হইল। তিনি তাঁহার স্বামীকে যেরকম করিয়া সেবা করেন তাহা চক্ষে দেখিয়া আমার প্রথম চৈতন্য জন্মিল। আমি যে-স্বামীকে কখনো দেখি নাই বলিলেই হয় আমার সমস্ত মনের ভক্তি তাঁহার উদ্দেশে যে কেমন করিয়া গেল, তাহা আমি বলিতে পারি না। ভগবান আমার সেই পূজার ফল দিয়াছেন, এখন আমার স্বামী আমার মনের সম্মুখে স্পষ্ট করিয়া জাগিয়া উঠিয়াছেন, তিনি আমাকে গ্রহণ না’ই করিলেন–কিন্তু আমি তাঁহাকে এখন পাইয়াছি।”

কমলার এই ভক্তিসিঞ্চিত কথা কয়টি শুনিয়া হেমনলিনীর অন্তঃকরণ আর্দ্র হইয়া গেল। সে খানিক ক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া কহিল, “তোমার কথা আমি বেশ বুঝিতে পারিতেছি। অমনি করিয়া পাওয়াই পাওয়া। আর সমস্ত পাওয়া লোভের পাওয়া, তাহা নষ্ট হইয়া যায়।”

কমলা এ কথা সম্পূর্ণ বুঝিল কি না বলা যায় না–সে হেমনলিনীর দিকে চাহিয়া রহিল, খানিক বাদে কহিল, “তুমি যাহা বলিতেছ দিদি, তা সত্যই হইবে। আমি মনে কোনো দুঃখ আসিতে দিই না, আমি ভালোই আছি ভাই! আমি যেটুকু পাইয়াছি তাই আমার লাভ।”

হেমনলিনী কমলার হাত নিজের হাতে তুলিয়া লইয়া কহিল, “যখন ত্যাগ এবং লাভ একেবারে সমান হইয়া যায় তখনই তাহা যথার্থ লাভ, এই কথা আমার গুরু বলেন। সত্য বলিতেছি বোন, তোমার মতো অমনি সমস্ত নিবেদন করিয়া দিয়া যে সার্থকতা তাহাই যদি আমার ঘটে, তবে আমি ধন্য হইব।”

কমলা কিছু বিস্মিত হইয়া কহিল, “কেন দিদি, তুমি তো সবই পাইবে, তোমার তো কোনো অভাবই থাকিবে না।”

হেননলিনী কহিল, “যেটুকু পাইবার মতো পাওয়া সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হইতে পারি; তার চেয়ে বেশি যতটুকুই পাওয়া যায় তার অনেক ভার, অনেক দুঃখ। আমার মুখে এ-সব কথা তোমার আশ্চর্য লাগিবে, আমার নিজেরও আশ্চর্য লাগে, কিন্তু এ-সব কথা ঈশ্বর আমাকে ভাবাইতেছেন। জান না, বোন, আজ আমার মনে কী ভার চাপিয়া ছিল–তোমাকে পাইয়া আমার হৃদয় হালকা হইল, আমি বল পাইলাম, তাই আমি এত বকিতেছি। আমি কখনো কথা কহিতে পারি না, তুমি কেমন করিয়া আমার সব কথা টানিয়া লইতেছ ভাই?”

৫৯

ক্ষেমংকরীর নিকট হইতে ফিরিয়া আসিয়া হেমনলিনী তাহাদের বসিবার ঘরের টেবিলের উপর একখানা মস্ত ভারী চিঠি পাইল। লেফাফার উপরকার হস্তাক্ষর দেখিয়াই বুঝিতে পারিল, চিঠিখানা রমেশের লেখা। স্পন্দিতবক্ষে চিঠিখানি হাতে করিয়া শয়নগৃহের দ্বার রুদ্ধ করিয়া পড়িতে লাগিল।

চিঠিতে রমেশ কমলা-সম্বন্ধীয় সমস্ত ব্যাপার আনুপূর্বিক বিস্তারিতভাবে লিখিয়াছে। উপসংহারে লিখিয়াছে–

তোমার সহিত আমার যে বন্ধন ঈশ্বর দৃঢ় করিয়া দিয়াছিলেন, সংসার তাহা ছিন্ন করিয়াছে। তুমি এখন অন্যের প্রতি চিত্ত সমর্পণ করিয়াছ–সেজন্য আমি তোমাকে কোনো দোষ দিতে পারি না, কিন্তু তুমিও আমাকে দোষ দিয়ো না। যদিও আমি এক দিনের জন্য কমলার প্রতি স্ত্রীর মতো ব্যবহার করি নাই তথাপি ক্রমশ সে যে আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়া লইয়াছিল, এ কথা তোমার কাছে আমার স্বীকার করা কর্তব্য। আজ আমার হৃদয় কী অবস্থায় আছে তাহা আমি নিশ্চয় জানি না। তুমি যদি আমাকে ত্যাগ না করিতে তবে তোমার মধ্যে আমি আশ্রয় লাভ করিতে পারিতাম। সেই আশ্বাসেই আমি আমার বিক্ষিপ্ত চিত্ত লইয়া তোমার নিকট ছুটিয়া আসিয়াছিলাম। কিন্তু আজ যখন স্পষ্ট দেখিলাম তুমি আমাকে ঘৃণা করিয়া আমার নিকট হইতে বিমুখ হইয়াছ, যখন শুনিলাম অন্যের সহিত বিবাহ-সম্বন্ধে তুমি সম্মতি দিয়াছ, তখন আমারও মন আবার দোলায়িত হইয়া উঠিল। দেখিলাম এখনো কমলাকে সম্পূর্ণ ভুলিতে পারি নাই। ভুলি বা না ভুলি, তাহাতে সংসারে আমি ছাড়া আর-কাহারো কোনো ক্ষতি নাই। আমারই বা ক্ষতি কিসের! সংসারে যে দুটি রমণীকে আমি হৃদয়ের মধ্যে গ্রহণ করিতে পারিয়াছি তাঁহাদিগকে বিস্মৃত হইবার সাধ্য আমার নাই এবং তাঁহাদিগকে চিরজীবন স্মরণ করাই আমার পরম লাভ। আজ প্রাতে যখন তোমার সহিত ক্ষণিক সাক্ষাতের বিদ্যুদ্‌বৎ আঘাত প্রাপ্ত হইয়া বাসায় ফিরিয়া আসিলাম তখন একবার মনে মনে বলিলাম, “আমি হতভাগ্য!’ কিন্তু আর আমি সে কথা স্বীকার করিব না। আমি সবলচিত্তে আনন্দের সহিত তোমার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিতেছি–আমি পরিপূর্ণ-হৃদয়ে তোমার নিকট হইতে প্রস্থান করিব–তোমাদের কল্যাণে, বিধাতার কল্যাণে, আমি অন্তরের মধ্যে এই বিদায়কালে যেন কিছুমাত্র দীনতা অনুভব না করি। তুমি সুখী হও, তোমার মঙ্গল হউক। আমাকে তুমি ঘৃণা করিয়ো না, আমাকে ঘৃণা করিবার কোনো কারণ তোমার নাই।

0 Shares