নৌকা ডুবি

চক্রবর্তী, শৈল ও কমলার কাছে আসিয়া দেখিলেন, কমলার দুটি চক্ষু চোখের জলের আভাসে এখনো ছল্‌ছল্‌ করিতেছে! চক্রবর্তী শৈলজার পাশে বসিয়া নীরবে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন। শৈল কহিল, “বাবা, আমি কমলকে বলিতেছিলাম যে, নলিনাক্ষবাবুকে সকল কথা খুলিয়া বলিবার এখন সময় হইয়াছে, তাই লইয়া তোমার এই নির্বোধ হরিদাসী আমার সঙ্গে ঝগড়া করিতেছে।”

কমলা বলিয়া উঠিল, “না দিদি, না, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, তুমি এমন কথা মুখে আনিয়ো না। সে কিছুতেই হইবে না।”

শৈল কহিল, “কী তোমার বুদ্ধি! তুমি চুপ করিয়া থাকো, আর হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষবাবুর বিবাহ হইয়া যাক। বিবাহের পরদিন হইতে আর আজ পর্যন্ত কেবলই তো যত রাজ্যের অঘটন ঘটনার মধ্যে পাক খাইয়া মরিলি, আবার আর-একটা নূতন অনাসৃষ্টির দরকার কী?”

কমলা কহিল, “দিদি, আমার কথা কাহাকেও বলিবার নয়, আমি সব সহিতে পারিব, সে লজ্জা সহিতে পারিব না। আমি যেমন আছি, বেশ আছি, আমার কোনো দুঃখ নাই, কিন্তু যদি সব কথা প্রকাশ করিয়া দাও তবে আমি কোন্‌ মুখে আর একদণ্ড এ বাড়িতে থাকিব? তবে আমি বাঁচিব কেমন করিয়া?”

শৈল এ কথার কোনো উত্তর দিতে পারিল না, কিন্তু তাই বলিয়া হেমনলিনীর সঙ্গে নলিনাক্ষের বিবাহ হইয়া যাইবে ইহা চুপ করিয়া সহ্য করা তাহার পক্ষে বড়ো কঠিন।

চক্রবর্তী কহিলেন, “যে বিবাহের কথা বলিতেছ সেটা ঘটিতেই হইবে, এমন কী কথা আছে!”

শৈল। বল কী বাবা, নলিনাক্ষবাবুর মা যে আশীর্বাদ করিয়া আসিয়াছেন!

চক্রবর্তী। বিশ্বেশ্বরের আশীর্বাদে সে আশীর্বাদ ফাঁসিয়া গেছে। মা কমল, তোমার কোনো ভয় নাই, ধর্ম তোমার সহায় আছেন।

কমলা সব কথা স্পষ্ট না বুঝিয়া দুই চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া খুড়ামশায়ের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।

তিনি কহিলেন, “সে বিবাহের সম্বন্ধ ভাঙিয়া গেছে। এ বিবাহে নলিনাক্ষবাবুও রাজি নহেন এবং তাঁহার মার মাথায়ও সুবুদ্ধি আসিয়াছে।”

শৈলজা ভারি খুশি হইয়া কহিল, “বাঁচা গেল বাবা! কাল এই খবরটা শুনিয়া রাত্রে আমি ঘুমাইতে পারি নাই। কিন্তু সে যাই হোক, কমল কি নিজের ঘরে চিরদিন এমনি পরের মতো কাটাইবে? কবে সব পরিষ্কার হইয়া যাইবে?”

চক্রবর্তী। ব্যস্ত হোস কেন শৈল? যখন ঠিক সময় আসিবে তখন সমস্ত সহজ হইয়া যাইবে।

কমলা কহিল, “এখন যা হইয়াছে এই সহজ, এর চেয় সহজ আর-কিছু হইতে পারে না। আমি বেশ সুখে আছি, আমাকে এর চেয়ে সুখ দিতে গিয়া আবার আমার ভাগ্যকে ফিরাইয়া দিয়ো না খুড়ামশায়! আমি তোমাদের পায়ে ধরি, তোমরা কাহাকেও কিছু বলিয়ো না, আমাকে এই ঘরের একটা কোণে ফেলিয়া আমার কথা ভুলিয়া যাও। আমি খুব সুখে আছি।”

বলিতে বলিতে কমলার দুই চোখ দিয়া ঝর্‌ ঝর্‌ করিয়া জল পড়িতে লাগিল।

চক্রবর্তী ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, “ও কী, মা, কাঁদ কেন? তুমি যাহা বলিতেছ আমি বেশ বুঝিতেছি। তোমার এই শান্তিতে আমরা কি হাত দিতে পারি? বিধাতা আপনি যা ধীরে ধীরে করিতেছেন, আমরা নির্বোধের মতো তার মধ্যে পড়িয়া কি সমস্ত ভণ্ডুল করিয়া দিব? কোনো ভয় নাই। আমার এত বয়স হইয়া গেল, আমি কি স্থির হইয়া থাকিতে জানি না?”

এমন-সময় উমেশ ঘরে প্রবেশ করিয়া তাহার আকর্ণবিস্ফারিত হাস্য লইয়া দাঁড়াইল।

খুড়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী রে উম্‌শে, খবর কী?”

উমেশ কহিল, “রমেশবাবু নীচে দাঁড়াইয়া আছেন, ডাক্তারবাবুর কথা জিজ্ঞাসা করিতেছেন।”

কমলার মুখ পাংশুবর্ণ হইয়া গেল। খুড়া তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িলেন; কহিলেন “ভয় নাই মা, আমি সব ঠিক করিয়া দিতেছি।”

খুড়া নীচে আসিয়া একেবারে রমেশের হাত ধরিয়া কহিলেন, “আসুন রমেশবাবু, রাস্তায় বেড়াইতে বেড়াইতে আপনার সঙ্গে গোটা-দুয়েক কথা কহিব।”

রমেশ আশ্চর্য হইয়া কহিল, “খুড়ামশায়, আপনি এখানে কোথা হইতে?”

খুড়া কহিলেন, “আপনার জন্য আছি; দেখা হইল, বড়ো ভালোই হইল। আসুন, আর দেরি নয়, কাজের কথাটা শেষ করিয়া ফেলা যাক!”

বলিয়া রমেশকে রাস্তায় টানিয়া লইয়া কিছুদূর গিয়া কহিলেন, “রমেশবাবু, আপনি এ বাড়িতে কেন আসিয়াছেন?”

রমেশ কহিল, “নলিনাক্ষ ডাক্তারকে খুঁজিতে আসিয়াছিলাম। তাঁহাকে কমলার কথা আগাগোড়া সমস্ত খুলিয়া বলা উচিত স্থির করিয়াছি। আমার এক-একবার মনে হয়, হয়তো কমলা বাঁচিয়া আছে।”

খুড়া কহিলেন, “যদি কমলা বাঁচিয়াই থাকে এবং যদি নলিনাক্ষের সঙ্গে তার দেখা হয়, তবে আপনার মুখে নলিনাক্ষ সমস্ত ইতিহাস শুনিলে কি সুবিধা হইবে। তাঁহার বৃদ্ধা মা আছেন, তিনি এ-সব কথা জানিতে পারিলে কমলার পক্ষে কি ভালো হইবে?”

রমেশ কহিল, “সামাজিক হিসাবে কী ফল হইবে জানি না, কিন্তু কমলাকে যে কোনো অপরাধ স্পর্শ করে নাই সেটা তো নলিনাক্ষের জানা চাই। কমলার যদি মৃত্যুই হইয়া থাকে, তবে নলিনাক্ষবাবু তাঁহার স্মৃতিকে তো সম্মান করিতে পারিবেন।”

খুড়া কহিলেন, “আপনাদের ও-সব একেলে কথা আমি কিছু বুঝিতে পারি না–কমলা যদি মরিয়াই থাকে তবে তাহার এক রাত্রির স্বামীর কাছে তাহার স্মৃতিটাকে লইয়া টানাটানি করিবার কোনো দরকার দেখি না। ঐ-যে বাড়িটা দেখিতেছেন ঐ বাড়িতে আমার বাসা। কাল সকালে যদি একবার আসিতে পারেন, তবে আপনাকে সব কথা স্পষ্ট করিয়া বলিব। কিন্তু তাহার পূর্বে নলিনাক্ষবাবুর সঙ্গে দেখা করিবেন না, এই আমার অনুরোধ।”

রমেশ বলিল, “আচ্ছা।”

0 Shares