নৌকা ডুবি

রমেশ ক্ষণকাল চুপ করিয়া থাকিয়া সবলে রুদ্ধ কণ্ঠ পরিষ্কার করিয়া লইয়া কহিল, “তুমি সুখী হও কমলা–আমি না জানিয়া এবং জানিয়া তোমার কাছে যা-কিছু অপরাধ করিয়াছি, সব মাপ করিয়ো।”

কমলা ইহার উত্তরে কিছুই বলিতে পারিল না, দেওয়াল ধরিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

রমেশ কিছুক্ষণ পরে কহিল, “যদি কাহাকেও কিছু বলিবার জন্য, কোনো বাধা দূর করিবার জন্য, আমাকে তোমার প্রয়োজন থাকে তো বলো।”

কমলা জোড়হাত করিয়া কহিল, “আমার কথা কাহারো কাছে বলিবেন না, আমার এই মিনতি রাখিবেন।”

রমেশ কহিল, “অনেক দিন তোমার কথা কাহারো কাছে বলি নাই, খুব গোলমালে পড়িলেও চুপ করিয়া কাটাইয়াছি। অল্পদিন হইল, যখন মনে করিয়াছিলাম তোমার কথা বলিলে তোমার কোনো ক্ষতি হইবে না, তখনই কেবল একটি পরিবারের কাছে তোমার কথা প্রকাশ করিয়াছি। তাহাতেও বোধ হয় তোমার অনিষ্ট না হইয়া ভালোই হইতে পারে। খুড়ামশায় বোধ হয় খবর পাইয়া থাকিবেন–অন্নদাবাবু, যাঁহার মেয়ের সঙ্গে–”

খুড়া কহিলেন, “হেমনলিনী, জানি বৈকি। তাঁহারা সব শুনিয়াছেন?”

রমেশ কহিল, “হাঁ। তাঁহাদের কাছে আর কিছু বলা যদি প্রয়োজন বোধ করেন তবে আমি যাইতে পারি–কিন্তু আমার আর ইচ্ছা নাই–আমার অনেক সময় গেছে এবং আরো আমার অনেক গেছে, এখন আমি মুক্তি চাই–হাত-নাগাদ সমস্ত দেনা-পাওনা শোধ করিয়া দিয়া এখন বাহির হইতে পারিলে বাঁচি!”

খুড়া রমেশের হাত ধরিয়া সস্নেহকণ্ঠে কহিলেন, “না রমেশবাবু, আপনাকে আর কিছুই করিতে হইবে না। আপনাকে অনেক বহন করিতে হইয়াছে, এখন ভারমুক্ত হইয়া নিজেকে স্বাধীনভাবে চালনা করুন, সুখী হউন, সার্থক হউন, এই আমার আশীর্বাদ!”

যাইবার সময় রমেশ কমলার দিকে চাহিয়া কহিল, “আমি তবে চলিলাম।”

কমলা কোনো কথা না কহিয়া আর-একবার ভূতলে মাথা ঠেকাইয়া রমেশকে প্রণাম করিল।

রমেশ পথে বাহির হইয়া স্বপ্নাবিষ্টের মতো চলিতে চলিতে ভাবিতে লাগিল, “কমলার সঙ্গে দেখা হইল, ভালোই হইল; দেখা না হইলে এ পালাটা ভালো করিয়া শেষ হইত না। যদিও ঠিক জানিলাম না, কমলা কী জানিয়া কী বুঝিয়া সে রাত্রে হঠাৎ গাজিপুরের বাংলা ছাড়িয়া চলিয়া আসিল, কিন্তু ইহা বুঝা গেছে, আমি এখন সম্পূর্ণই অনাবশ্যক। এখন আমার আবশ্যক কেবল নিজের জীবনটুকু লইয়া, এখন তাহাকেই সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ করিয়া পৃথিবীতে বাহির হইলাম–আমার আর পিছনে ফিরিয়া তাকাইবার কোনো প্রয়োজন নাই।’

৬২

কমলা বাড়ি ফিরিয়া আসিয়া দেখিল–অন্নদাবাবু ও হেমনলিনী ক্ষেমংকরীর কাছে বসিয়া আছে। কমলাকে দেখিয়া ক্ষেমংকরী কহিলেন, “এই-যে হরিদাসী, তোমার বন্ধুকে তোমার ঘরে লইয়া যাও বাছা! আমি অন্নদাবাবুকে চা খাওয়াইতেছি।”

কমলার ঘরে প্রবেশ করিয়াই হেমনলিনী কমলার গলা ধরিয়া কহিল, “কমলা!”

কমলা খুব বেশি বিস্মিত না হইয়া কহিল, “তুমি কেমন করিয়া জানিলে আমার নাম কমলা।”

হেমনলিনী কহিল, “একজনের কাছে আমি তোমার জীবনের ঘটনা সব শুনিয়াছি। যেমনি শুনিলাম অমনি তখনই আমার মনে সন্দেহ রহিল না তুমিই কমলা। কেন যে, তা বলিতে পারি না।”

কমলা কহিল, “ভাই, আমার নাম যে কেহ জানে সে আমার ইচ্ছা নয়। আমার নিজের নামে একেবারে ধিক্‌কার জন্মিয়া গেছে।”

হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু ঐ নামের জোরেই তো তোমাকে তোমার অধিকার পাইতে হইবে।”

কমলা মাথা নাড়িয়া কহিল, “ও আমি বুঝি না। আমার জোর কিছুই নাই, আমার অধিকার কিছুই নাই, আমি জোর খাটাইতেই চাই না।”

হেমনলিনী কহিল, “কিন্তু তোমার স্বামীকে তোমার পরিচয় হইতে বঞ্চিত করিবে কী বলিয়া। তোমার ভালোমন্দ সবই কি তাঁহার কাছে নিবেদন করিবে না? তাঁর কাছে কি কিছু লুকানো চলিবে?”

হঠাৎ কমলার মুখ যেন বিবর্ণ হইয়া গেল–সে কোনো উত্তর খুঁজিয়া না পাইয়া নিরূপায়ভাবে হেমনলিনীর মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল। আস্তে আস্তে কমলা মেজের মাদুরের ‘পরে বসিয়া পড়িল; কহিল, “ভগবান তো জানেন, আমি কোনো অপরাধ করি নাই, তবে তিনি কেন আমাকে এমন করিয়া লজ্জায় ফেলিবেন? যে পাপ আমার নয় তার শাস্তি আমাকে কেন দিবেন? আমি কেমন করিয়া তাঁর কাছে আমার সব কথা প্রকাশ করিব?”

হেমনলিনী কমলার হাত ধরিয়া কহিল, “শাস্তি নয় ভাই, তোমার মুক্তি হইবে। যতদিন তুমি তোমার স্বামীর কাছে আপনাকে গোপন করিয়া রাখিতেছ ততদিন তুমি আপনাকে একটা মিথ্যার বন্ধনে জড়িত করিতেছ–তাহা তেজের সহিত ছিঁড়িয়া ফেলো, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করিবেনই।”

কমলা কহিল, “আবার পাছে সব হারাই এই ভয় যখন মনে আসে তখন সব বল চলিয়া যায়। কিন্তু তুমি যা বলিতেছি আমি তা বুঝিয়াছি–অদৃষ্টে যা থাকে তা হোক, কিন্তু তাঁর কাছে আপনাকে লুকানো আর চলিবে না, তিনি আমার সবই জানিবেন।”

এই বলিতে বলিতে সে আপনার দুই হাত দৃঢ়বলে বদ্ধ করিল।

হেমনলিনী সকরুণচিত্তে কহিল, “তুমি কি চাও আর-কেহ তোমার কথা তাঁহাকে জানায়?”

কমলা সবেগে মাথা নাড়িয়া কহিল, “না না, আর-কাহারো মুখ হইতে তিনি শুনিবেন না–আমার কথা আমিই তাঁহাকে বলিব–আমি বলিতে পারিব।”

হেমনলিনী কহিল, “সেই কথাই ভালো। তোমার সঙ্গে আমার আর দেখা হবে কি না, জানি না। আমরা এখান হইতে চলিয়া যাইতেছি, তাহা তোমাদের বলিতে আসিয়াছি।”

কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কোথায় যাইবে?”

হেমনলিনী কহিল, “কলিকাতায়। তোমাদের সকালে কাজকর্ম আছে, আমরা আর দেরি করিব না। আমি তবে আসি ভাই! বোনকে মনে রাখিয়ো।”

0 Shares