নৌকা ডুবি

কমলার সৌন্দর্য এই কয় মাসে রমেশের মনে আবছায়ার মতো হইয়া আসিয়াছিল, আজ সেই সৌন্দর্য নবতর বিকাশ লাভ করিয়া হঠাৎ তাহাকে চমক লাগাইয়া দিল। সে যেন ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না।

রমেশ কহিল, “কমলা, বোসো।”

কমলা একটা চৌকিতে বসিল। রমেশ কহিল, “ইস্কুলে তোমার পড়াশুনা কেমন চলিতেছে?”

কমলা অত্যন্ত সংক্ষেপে কহিল, “বেশ।”

রমেশ ভাবিতে লাগিল এইবার কী বলা যাইবে। হঠাৎ একটা কথা মনে পড়িয়া গেল; কহিল, “বোধ হয় অনেকক্ষণ খাও নাই। তোমার খাবার তৈরি আছে। এইখানেই আনিতে বলি?”

কমলা কহিল, “খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”

রমেশ কহিল, “একটু কিছু খাইবে না? মিষ্টি না খাও তো ফল আছে– আতা, আপেল, বেদানা–”

কমলা কোনো কথা না বলিয়া ঘাড় নাড়িল।

রমেশ আর-একবার কমলার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিল। কমলা তখন ঈষৎ মুখ নত করিয়া তাহার ইংরাজিশিক্ষার বহি হইতে ছবি দেখিতেছিল। সুন্দর মুখ সোনার কাঠির মতো নিজের চারি দিকের সুপ্ত সৌন্দর্যকে জাগাইয়া তোলে। শরতের আলোক হঠাৎ যেন প্রাণ পাইল, আশ্বিনের দিন যেন আকার ধারণ করিল। কেন্দ্র যেমন তাহার পরিধিকে নিয়মিত করে– তেমনি এই মেয়েটি আকাশকে, বাতাসকে, আলোককে আপনার চারি দিকে যেন বিশেষভাবে আকর্ষণ করিয়া আনিল– অথচ সে নিজে ইহার কিছুই না জানিয়া চুপ করিয়া বসিয়া তাহার পড়িবার বইয়ের ছবি দেখিতেছিল।

রমেশ তাড়াতাড়ি উঠিয়া গিয়া একটা থালায় কতকগুলি আপেল, নাসপাতি, বেদানা লইয়া উপস্থিত করিল। কহিল, “কমলা, তুমি তো খাবে না দেখিতেছি, কিন্তু আমার ক্ষুধা পাইয়াছে, আমি তো আর সবুর করিতে পারি না।”

শুনিয়া কমলা একটুখানি হাসিল। এই অকস্মাৎ হাসির আলোকে উভয়ের ভিতরকার কুয়াশা যেন অনেকখানি কাটিয়া গেল।

রমেশ ছুরি লইয়া আপেল কাটিতে লাগিল। কিন্তু কোনোপ্রকার হাতের কাজে রমেশের কিছুমাত্র দক্ষতা নাই। তাহার এক দিকে ক্ষুধার আগ্রহ, অন্য দিকে এলোমেলো কাটিবার ভঙ্গি দেখিয়া বালিকার ভারি হাসি পাইল– সে খিল্‌ খিল্‌ করিয়া হাসিয়া উঠিল।

রমেশ এই হাস্যোচ্ছ্বাসে খুশি হইয়া কহিল, “আমি বুঝি ভালো কাটিতে পারি না, তাই হাসিতেছ? আচ্ছা, তুমি কাটিয়া দাও দেখি, তোমার কিরূপ বিদ্যা।”

কমলা কহিল, “বঁটি হইলে আমি কাটিয়া দিতে পারি, ছুরিতে পারি না।”

রমেশ কহিল, “তুমি মনে করিতেছ বঁটি এখানে নাই?” চাকরকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “বঁটি আছে?”

সে কহিল, “আছে– রাত্রের আহারের জন্য সমস্ত আনা হইয়াছে।”

রমেশ কহিল, “ভালো করিয়া ধুইয়া একটা বঁটি লইয়া আয়।”

চাকর বঁটি লইয়া আসিল। কমলা জুতা খুলিয়া বঁটি পাতিয়া নীচে বসিল এবং হাসিমুখে নিপুণহস্তে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া ফলের খোসা ছাড়াইয়া চাকলা চাকলা করিয়া কাটিতে লাগিল। রমেশ তাহার সম্মুখে মাটিতে বসিয়া ফলের খণ্ডগুলি থালায় ধরিয়া লইল।

রমেশ কহিল, “তোমাকেও খাইতে হইবে।”

কমলা কহিল, “না।”

রমেশ কহিল, “তবে আমিও খাইব না।”

কমলা রমেশের মুখের উপরে দুই চোখ তুলিয়া কহিল, “আচ্ছা, তুমি আগে খাও, তার পরে আমি খাইব।”

রমেশ কহিল, “দেখিয়ো, শেষকালে ফাঁকি দিয়ো না।”

কমলা গম্ভীরভাবে ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “না, সত্যি বলিতেছি, ফাঁকি দিব না।”

বালিকার এই সত্যপ্রতিজ্ঞায় আশ্বস্ত হইয়া রমেশ থালা হইতে এক টুকরা ফল লইয়া মুখে পুরিয়া দিল।

হঠাৎ তাহার চিবানো বন্ধ হইয়া গেল। হঠাৎ দেখিল, তাহার সম্মুখেই দ্বারের বাহিরে যোগেন্দ্র এবং অক্ষয় আসিয়া উপস্থিত।

অক্ষয় কহিল, “রমেশবাবু, মাপ করিবেন– আমি ভাবিয়াছিলাম, আপনি এখানে বুঝি একলাই আছেন। যোগেন, খবর না দিয়া হঠাৎ এমন করিয়া আসিয়া পড়াটা ভালো হয় নাই। চলো, আমরা নীচে বসি গিয়া।”

বঁটি ফেলিয়া কমলা তাড়াতাড়ি উঠিয়া পড়িল। ঘর হইতে পালাইবার পথেই দুজনে দাঁড়াইয়া ছিল। যোগেন্দ্র একটুখানি সরিয়া পথ ছাড়িয়া দিল, কিন্তু কমলার মুখের উপর হইতে চোখ ফিরাইল না– তাহাকে তীব্রদৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করিয়া দেখিয়া লইল। কমলা সংকুচিত হইয়া পাশের ঘরে চলিয়া গেল।

১৯

যোগেন্দ্র কহিল, “রমেশ, এই মেয়েটি কে?”

রমেশ কহিল, “আমার একটি আত্মীয়।”

যোগেন্দ্র কহিল, “কী রকমের আত্মীয়? বোধ হয় গুরুজন কেহ হইবেন না, স্নেহের সম্পর্কও বোধ হইল না। তোমার সকল আত্মীয়ের কথাই তো তোমার কাছ হইতে শুনিয়াছি– এ আত্মীয়ের তো কোনো বিবরণ শুনি নাই।”

অক্ষয় কহিল, “যোগেন, এ তোমার অন্যায়– মানুষের কি এমন কোনো কথা থাকিতে পারে না যাহা বন্ধুর কাছেও গোপনীয়?”

যোগেন্দ্র। কী রমেশ, অত্যন্ত গোপনীয় নাকি?

রমেশের মুখ লাল হইয়া উঠিল; সে কহিল, “হাঁ গোপনীয়। এই মেয়েটির সম্বন্ধে আমি তোমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করিতে ইচ্ছা করি না।”

যোগেন্দ্র। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে, আমি তোমার সঙ্গে আলোচনা করিতে বিশেষ ইচ্ছা করি। হেমের সহিত যদি তোমার বিবাহের প্রস্তাব না হইত, তবে কার সঙ্গে তোমার কতটা-দূর আত্মীয়তা গড়াইয়াছে তাহা লইয়া এত তোলাপাড়া করিবার কোনো প্রয়োজন হইত না– যাহা গোপনীয় তাহা গোপনেই থাকিত।

রমেশ কহিল, “এইটুকু পর্যন্ত আমি তোমাদিগকে বলিতে পারি– পৃথিবীতে কাহারো সহিত আমার এমন সম্পর্ক নাই যাহাতে হেমনলিনীর সহিত পবিত্র সম্বন্ধে বদ্ধ হইতে আমার কোনো বাধা থাকিতে পারে।”

যোগেন্দ্র। তোমার হয়তো কিছুতেই বাধা না থাকিতে পারে, কিন্তু হেমনলিনীর আত্মীয়দের থাকিতে পারে। একটা কথা আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করি, যার সঙ্গে তোমার যেরূপ আত্মীয়তা থাক্‌-না কেন তাহা গোপনে রাখিবার কী কারণ আছে?

0 Shares