নৌকা ডুবি

হেমনলিনী নিরুত্তর।

যোগেন্দ্র। আচ্ছা, বেশ কথা– তোমরা সরলস্বভাব, কাহাকেও সন্দেহ কর না– আশা করি, আমার উপরেও তোমার কতকটা বিশ্বাস আছে। আমি নিজে ইস্কুলে গিয়া খবর লইয়াছি, রমেশ তাহার স্ত্রী কমলাকে সেখানে বোর্ডার রাখিয়া পড়াইতেছিল। ছুটির সময়েও তাহাকে সেখানে রাখিবার বন্দোবস্ত করিয়াছিল। হঠাৎ দুই-তিন দিন হইল, ইস্কুলের কর্ত্রীর নিকট হইতে রমেশ চিঠি পাইয়াছে যে, ছুটির সময়ে কমলাকে ইস্কুলে রাখা হইবে না। আজ তাহাদের ছুটি ফুরাইয়াছে– কমলাকে ইস্কুলের গাড়ি দরজিপাড়ায় তাহাদের সাবেক বাসায় পৌঁছাইয়া দিয়াছে। সেই বাসায় আমি নিজে গিয়াছি। গিয়া দেখিলাম, কমলা বঁটিতে আপেলের খোসা ছাড়াইয়া কাটিয়া দিতেছে, রমেশ তাহার সুমুখে মাটিতে বসিয়া এক-এক টুকরা লইয়া মুখে পুরিতেছে। রমেশকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “ব্যাপারখানা কী?’ রমেশ বলিল, সে এখন আমাদের কাছে কিছুই বলিবে না। যদি রমেশ একটা কথাও বলিত যে, কমলা তাহার স্ত্রী নয়, তা হলেও না হয় সেই কথাটুকুর উপর নির্ভর করিয়া কোনোমতে সন্দেহকে শান্ত করিয়া রাখিবার চেষ্টা করা যাইত। কিন্তু সে হাঁ-না কিছুই বলিতে চায় না। এখন, ইহার পরেও কি রমেশের উপর বিশ্বাস রাখিতে চাও?

প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় যোগেন্দ্র হেমনলিনীর মুখের প্রতি নিরীক্ষণ করিয়া দেখিল তাহার মুখ অস্বাভাবিক বিবর্ণ হইয়া গেছে, এবং তাহার যতটা জোর আছে দুই হাতে চৌকির হাতা চাপিয়া ধরিবার চেষ্টা করিতেছে। মুহূর্তকাল পরেই সম্মুখের দিকে ঝুঁকিয়া পড়িয়া মূর্ছিত হইয়া চৌকি হইতে সে নীচে পড়িয়া গেল।

অন্নদাবাবু ব্যাকুল হইয়া পড়িলেন। তিনি ভূলুন্ঠিতা হেমনলিনীর মাথা দুই হাতে বুকের কাছে তুলিয়া লইয়া কহিলেন, “মা, কী হইল মা! ওদের কথা তুমি কিছুই বিশ্বাস করিয়ো না– সব মিথ্যা।”

যোগেন্দ্র তাহার পিতাকে সরাইয়া তাড়াতাড়ি হেমনলিনীকে একটা সোফার উপর তুলিল; নিকটে কুঁজায় জল ছিল, সেই জল লইয়া তাহার মুখে-চোখে বারংবার ছিটাইয়া দিল, এবং অক্ষয় একখানা হাতপাখা লইয়া তাহাকে বেগে বাতাস করিতে লাগিল।

হেমনলিনী অনতিকাল পরে চোখ খুলিয়াই চমকিয়া উঠিল; অন্নদাবাবুর দিকে চাহিয়া চীৎকার করিয়া বলিল, “বাবা, বাবা, অক্ষয়বাবুকে এখান হইতে সরিয়া যাইতে বলো।”

অক্ষয় পাখা রাখিয়া ঘরের বাহিরে দরজার আড়ালে গিয়া দাঁড়াইল। অন্নদাবাবু সোফার উপরে হেমনলিনীর পাশে বসিয়া তাহার মুখে-গায়ে হাত বুলাইতে লাগিলেন, এবং গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া কেবল একবার বলিলেন, “মা!”

দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর দুই চক্ষু দিয়া জল ঝরিয়া পড়িতে লাগিল; তাহার বুক ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিল; পিতার জানুর উপর বুক চাপিয়া ধরিয়া তাহার অসহ্য রোদনের বেগ সংবরণ করিতে চেষ্টা করিল। অন্নদাবাবু অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বলিতে লাগিলেন, “মা, তুমি নিশ্চিন্ত থাকো মা! রমেশকে আমি খুব জানি– সে কখনোই অবিশ্বাসী নয়, যোগেন নিশ্চয়ই ভুল করিয়াছে।”

যোগেন্দ্র আর থাকিতে পারিল না; কহিল, “বাবা, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ো না। এখকার মতো কষ্ট বাঁচাইতে গিয়া উহাকে দ্বিগুণ কষ্টে ফেলা হইবে। বাবা, হেমকে এখন কিছুক্ষণ ভাবিবার সময় দাও।”

হেমনলিনী তখনি পিতার জানু ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল, এবং যোগেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “আমার যাহা ভাবিবার, সব ভাবিয়াছি। যতক্ষণ তাঁহার নিজের মুখ হইতে না শুনিব, ততক্ষণ আমি কোনোমতেই বিশ্বাস করিব না ইহা নিশ্চয় জানিয়ো।”

এই কথা বলিয়া সে উঠিয়া পড়িল। অন্নদাবাবু ব্যস্ত হইয়া তাহাকে ধরিলেন; কহিলেন, “পড়িয়া যাইবে।”

হেমনলিনী অন্নদাবাবুর হাত ধরিয়া তাহার শোবার ঘরে গেল। বিছানায় শুইয়া কহিল, “বাবা, আমাকে একটুখানি একলা রাখিয়া যাও, আমি ঘুমাইব।”

অন্নদাবাবু কহিলেন, “হরির মাকে ডাকিয়া দিব? বাতাস করিবে?”

হেমনলিনী কহিল, “বাতাসের দরকার নাই বাবা!”

অন্নদাবাবু পাশের ঘরে গিয়া বসিলেন। এই কন্যাটিকে ছয় মাসের শিশু-অবস্থায় রাখিয়া ইহার মা মারা যায়, সেই হেমের মার কথা তিনি ভাবিতে লাগিলেন। সেই সেবা, সেই ধৈর্য, সেই চিরপ্রসন্নতা মনে পড়িল। সেই গৃহলক্ষ্মীরই প্রতিমার মতো যে মেয়েটি এতদিন ধরিয়া তাঁহার কোলের উপর বাড়িয়া উঠিয়াছে তাহার অনিষ্ট-আশঙ্কায় তাঁহার হৃদয় ব্যাকুল হইয়া উঠিল। পাশের ঘরে বসিয়া বসিয়া তিনি মনে মনে তাহাকে সম্বোধন করিয়া বলিতে লাগিলেন, “মা, তোমার সকল বিঘ্ন দূর হউক, চিরদিন তুমি সুখে থাকো। তোমাকে সুখী দেখিয়া, সুস্থ দেখিয়া, যাহাকে ভালোবাস তাহার ঘরের মধ্যে লক্ষ্মীর মতো প্রতিষ্ঠিত দেখিয়া, আমি যেন তোমার মার কাছে যাইতে পারি।’ এই বলিয়া জামার প্রান্তে আর্দ্র চক্ষু মুছিলেন।

মেয়েদের বুদ্ধির প্রতি যোগেন্দ্রর পূর্ব হইতেই যথেষ্ট অবজ্ঞা ছিল, আজ তাহা আরো দৃঢ় হইল। ইহারা প্রত্যক্ষ প্রমাণও বিশ্বাস করে না– ইহাদিগকে লইয়া কী করা যাইবে? দুইয়ে দুইয়ে যে চার হইবেই, তাহাতে মানুষের সুখই হউক আর দুঃখই হউক, তাহা ইহারা স্থলবিশেষে অনায়াসেই অস্বীকার করিতে পারে। যুক্তি যদি কালোকে কালোই বলে, আর ইহাদের ভালোবাসা তাহাকে বলে সাদা, তবে যুক্তি-বেচারার উপরে ইহারা ভারি খাপা হইয়া উঠিবে। ইহাদিগকে লইয়া যে কী করিয়া সংসার চলে তাহা যোগেন্দ্র কিছুতেই ভাবিয়া পাইল না।

0 Shares