নৌকা ডুবি

রমেশ কহিল, “কিন্তু দেরি হইলে এই বিছানাপত্র কিছুই দেখিতে পাইবে না–তখন আমার দোষ দিয়ো না।”

রসিকতার এই পুনরুক্তিতে কমলার কম আমোদ বোধ হইল না। তাহার আবার ভারি হাসি পাইল। সরল হাস্যোচ্ছ্বাসে ঘরকে সুধাময় করিয়া দিয়া কমলা দ্রুতপদে খাবার আনিতে গেল। রমেশের কাষ্ঠপ্রফুল্লতার ছদ্মদীপ্তি মুহূর্তের মধ্যে কালিমায় ব্যাপ্ত হইল।

উপরে-শালপাতা-ঢাকা একটা চাঙারি লইয়া অনতিকাল পরেই কমলা কামরায় প্রবেশ করিল। বিছানার উপরে চাঙারি রাখিয়া আাঁচল দিয়া ঘরের মেঝে মুছিতে লাগিল।

রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “ও কী করিতেছ?”

কমলা কহিল, “আমি তো এখনি কাপড় ছাড়িয়া ফেলিব।” এই বলিয়া শালপাতা তুলিয়া পাতিল ও তাহার উপরে লুচি ও তরকারি নিপুণ হস্তে সাজাইয়া দিল।

রমেশ কহিল, “কী আশ্চর্য! লুচির জোগাড় করিলে কী করিয়া?’

কমলা সহজে রহস্য ফাঁস না করিয়া অত্যন্ত নিগূঢ়ভাব ধারণ করিয়া কহিল, “কেমন করিয়া বলো দেখি।”

রমেশ কঠিন চিন্তার ভাব করিয়া কহিল, “নিশ্চয়ই খালাসিদের জলখাবার হইতে ভাগ বসাইয়াছ।”

কমলা অত্যন্ত উত্তেজিত হইয়া কহিল, “কক্‌খনো না। রাম বলো!”

রমেশ খাইতে খাইতে লুচির আদিকারণ সম্বন্ধে যত রাজ্যের অসম্ভব কল্পনা দ্বারা কমলাকে রাগাইয়া তুলিল। যখন বলিল “আরব্য-উপন্যাসের প্রদীপওয়ালা আলাদীন বেলুচিস্থান হইতে গরম-গরম ভাজাইয়া তাহার দৈত্যকে দিয়া সওগাদ পাঠাইয়াছে’ তখন কমলার আর ধৈর্য কিছুতেই রহিল না; সে মুখ ফিরাইয়া কহিল, “তবে যাও আমি বলিব না।”

রমেশ ব্যস্ত হইয়া কহিল, “না, না, আমি হার মানিতেছি। মাঝদরিয়ায় লুচি,এ যে কেমন করিয়া সম্ভব হইতে পারে, আমি তো ভাবিয়া পাইতেছি না, কিন্তু তবু খাইতে চমৎকার লাগিতেছে।”

এই বলিয়া রমেশ তত্ত্বনির্ণয় অপেক্ষা ক্ষুধানিবৃত্তির শ্রেষ্ঠতা সবেগে সপ্রমাণ করিতে লাগিল।

স্টীমার চরে ঠেকিয়া গেলে, শূন্যভাণ্ডারপূরণের চেষ্টায় কমলা উমেশকে গ্রামে পাঠাইয়াছিল। স্কুলে থাকিতে জলপানি-স্বরূপে রমেশ কমলাকে যে কয়টি টাকা দিয়াছিল, তাহারই মধ্য হইতে অল্প কিছু বাঁচিয়াছিল, তাহাই দিয়া কিছু ঘি-ময়দা সংগ্রহ হইল। উমেশকে কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “উমেশ, তুই কী খাবি বল্‌ দেখি।”

উমেশ কহিল, “মাঠাকরুন, দয়া কর যদি, গ্রামে গোয়ালার বাড়িতে বড়ো সরেস দই দেখিয়া আসিলাম। কলা তো ঘরেই আছে, আর পয়সা-দুয়েকের চিঁড়ে-মুড়কি হইলেই পেট ভরিয়া আজ ফলার করিয়া লই।”

লুব্ধ বালকের ফলারের উৎসাহে কমলাও উৎসাহিত হইয়া উঠিল; কহিল, “পয়সা কিছু বাঁচিয়াছে উমেশ?”

উমেশ কহিল, “কিছু না মা।”

কমলা মুশকিলে পড়িয়া গেল। রমেশের কাছে কেমন করিয়া মুখ ফুটিয়া টাকা চাহিবে, তাই ভাবিতে লাগিল। একটু পরে বলিল, “তোর ভাগ্যে আজ যদি ফলার না’ই জোটে, তবে লুচি আছে–তোর ভাবনা নাই। চল্‌, ময়দা মাখবি চল্‌।”

উমেশ কহিল, “কিন্তু মা, দই যা দেখিয়া আসিলাম সে আর কী বলিব।”

কমলা কহিল, “দেখ্‌ উমেশ, বাবু যখন খাইতে বসিবেন তখন তুই তোর বাজারের পয়সা চাইতে আসিস।”

রমেশের আহার কতকটা অগ্রসর হইলে, উমেশ আসিয়া দাঁড়াইয়া সসংকোচে মাথা চুলকাইতে লাগিল। রমেশ তাহার মুখের দিকে চাহিল। সে অর্ধোক্তিতে কহিল, “মা, বাজারের পয়সা–”

তখন রমেশের হঠাৎ চেতনা হইল যে, আহারের আয়োজন করিতে হইলে অর্থের প্রয়োজন হয়, আলাদীনের প্রদীপের অপেক্ষা করিলে চলে না। ব্যস্ত হইয়া কহিল, “কমলা, তোমার কাছে তো টাকা কিছুই নাই। আমাকে মনে করাইয়া দাও নাই কেন?”

কমলা নীরবে অপরাধ স্বীকার করিয়া লইল। আহারান্তে রমেশ কমলার হাতে একটি ছোটো ক্যাশব্যাক্স দিয়া কহিল, “এখনকার মতো তোমার ধনরত্ন সব এইটেতেই রহিল।”

এইরূপে গৃহিণীপনার সমস্ত ভারই আপনা হইতেই কমলার হাতে গিয়া পড়িতেছে, রমেশ তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া আবার একবার জাহাজের রেলিং ধরিয়া পশ্চিম আকাশের দিকে চাহিল। পশ্চিম আকাশ দেখিতে দেখিতে তাহার চোখের উপরে সম্পূর্ণ অন্ধকার হইয়া আসিল।

উমেশ আজ পেট ভরিয়া চিঁড়ে দই কলা মাখিয়া ফলার করিল। কমলা সম্মুখে দাঁড়াইয়া তাহার জীবনবৃত্তান্ত সবিস্তারে আয়ত্ত করিয়া লইল।

বিমাতা-শাসিত গৃহের উপেক্ষিত উমেশ কাশীতে তাহার মাতামহীর কাছে পালাইয়া যাইতেছিল; সে কহিল, “মা, যদি তোমাদের কাছেই রাখ তবে আমি আর কোথাও যাই না।”

মাতৃহীন বালকের মুখে মা-সম্ভাষণ শুনিয়া বালিকার কোমল হৃদয়ের কোন্‌-এক গভীরদেশ হইতে জননী সাড়া দিল; কমলা স্নিগ্ধস্বরে কহিল, “বেশ তো উমেশ, তুই আমাদের সঙ্গেই চল্‌।”

২৫

তীরের বনরাজি অবিচ্ছিন্ন মসীলেখায় সন্ধ্যবধূর সোনার অঞ্চলে কালো পাড় টানিয়া দিল। গ্রামান্তরের বিলের মধ্যে সমস্ত দিন চরিয়া বন্যহংসের দল আকাশের ম্লানায়মান সূর্যাস্তদীপ্তির মধ্য দিয়া ও পারের তরুশূন্য বালুচরে নিভৃত জলাশয়গুলিতে রাত্রিযাপনের জন্য চলিয়াছে। কাকেদের বাসায় আসিবার কলরব থামিয়া গেছে। নদীতে তখন নৌকা ছিল না; একটিমাত্র বড়ো ডিঙি গাঢ় সোনালি-সবুজ নিস্তরঙ্গ জলের উপর দিয়া আপন কালিমা বহিয়া নিঃশব্দে গুণ টানিয়া চালিয়াছিল।

রমেশ জাহাজের ছাদের সম্মুখভাগে নবোদিত শুক্লপক্ষের তরুণ চাঁদের আলোকে বেতের কেদারা টানিয়া লইয়া বসিয়া ছিল।

পশ্চিম-আকাশ হইতে সন্ধ্যার শেষ স্বর্ণচ্ছায়া মিলাইয়া গেল; চন্দ্রালোকের ইন্দ্রজালে কঠিন জগৎ যেন বিগলিত হইয়া আসিল। রমেশ আপনা-আপনি মৃদুস্বরে বলিতে লাগিল “হেম, হেম!” সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন সুমধুর স্পর্শরূপে তাহার সমস্ত হৃদয়কে বারংবার বেষ্টন করিয়া প্রদক্ষিণ করিয়া ফিরিল, সেই নামের শব্দটিমাত্র যেন অপরিমেয়করুণারসার্দ্র দুইটি চক্ষুরূপে তাহার মুখের উপরে বেদনা বিকীর্ণ করিয়া চাহিয়া রহিল। রমেশের সর্বশরীর পুলকিত এবং দুই চক্ষু অশ্রুসিক্ত হইয়া আসিল।

0 Shares