নৌকা ডুবি

তাহার গত দুই বৎসরের জীবনের সমস্ত ইতিহাস তাহার মনের সম্মুখে প্রসারিত হইয়া গেল; হেমনলিনীর সহিত তাহার প্রথম পরিচয়ের দিন মনে পড়িয়া গেল। সে দিনকে রমেশ তাহার জীবনের একটি বিশেষ দিন বলিয়া চিনিতে পারে নাই। যোগেন্দ্র যখন তাহাকে তাহাদের চায়ের টেবিলে লইয়া গেল, সেখানে হেমনলিনীকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া লাজুক রমেশ আপনাকে নিতান্ত বিপন্ন বোধ করিয়াছিল। অল্পে অল্পে লজ্জা ভাঙিয়া গেল, হেমনলিনীর সঙ্গ অভ্যস্ত হইয়া আসিল, ক্রমে সেই অভ্যাসের বন্ধন রমেশকে বন্দী করিয়া তুলিল। কাব্যসাহিত্যে রমেশ প্রেমের কথা যাহা-কিছু পড়িয়াছিল সমস্তই সে হেমনলিনীর প্রতি আরোপ করিতে আরম্ভ করিল। “আমি ভালোবাসিতেছি’ মনে করিয়া সে মনে মনে একটা অহংকার অনুভব করিল। তাহার সহপাঠীরা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হইবার জন্য ভালোবাসার কবিতার অর্থ মুখস্থ করিয়া মরে, আর রমেশ সত্যসত্যই ভালোবাসে, ইহা চিন্তা করিয়া অন্য ছাত্রদিগকে সে কৃপাপাত্র মনে করিত। রমেশ আজ আলোচনা করিয়া দেখিল, সেদিনও সে ভালোবাসার বহির্‌দ্বারেই ছিল। কিন্তু যখন অকস্মাৎ কমলা আসিয়া তাহার জীবন-সমস্যাকে জটিল করিয়া তুলিল তখনই নানা বিরুদ্ধ ঘাতপ্রতিঘাতে দেখিতে দেখিতে হেমনলিনীর প্রতি তাহার প্রেম আকার ধারণ করিয়া, জীবন গ্রহণ করিয়া, জাগ্রত হইয়া উঠিল।

রমেশ তাহার দুই করতলের উপরে শির নত করিয়া ভাবিতে লাগিল, সম্মুখে সমস্ত জীবনই তো পড়িয়া রহিয়াছে, তাহার ক্ষুধিত উপবাসী জীবন–দুশ্ছেদ্য সংকটজালে বিজড়িত। এ জাল কি সে সবলে দুই হাত দিয়া ছিন্ন করিয়া ফেলিবে না?

এই বলিয়া সে দৃঢ়সংকল্পের আবেগে হঠাৎ মুখ তুলিয়া দেখিল, অদূরে আর-একটা বেতের চৌকির পিঠের উপরে হাত রাখিয়া কমলা দাঁড়াইয়া আছে। কমলা চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল, “তুমি ঘুমাইয়া পড়িয়াছিলে, আমি বুঝি তোমাকে জাগাইয়া দিলাম?”

অনুতপ্ত কমলাকে চলিয়া যাইতে উদ্যত দেখিয়া রমেশ তাড়াতাড়ি কহিল, “না না কমলা, আমি ঘুমাই নাই–তুমি বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি।”

গল্পের কথা শুনিয়া কমলা পুলকিত হইয়া চৌকি টানিয়া লইয়া বসিল। রমেশ স্থির করিয়াছিল, কমলাকে সমস্ত কথা প্রকাশ করিয়া বলা অত্যাবশ্যক হইয়াছে। কিন্তু এতবড়ো একটা আঘাত হঠাৎ সে দিতে পারিল না-তাই বলিল, “বোসো, তোমাকে একটা গল্প বলি।”

রমেশ কহিল, “সেকালে এক জাতি ক্ষত্রিয় ছিল, তাহারা–”

কমলা জিজ্ঞাসা করিল, “কবেকার কালে? অনে–ক কাল আগে?”

রমেশ কহিল, “হাঁ, সে অনেক কাল আগে। তখন তোমার জন্ম হয় নাই।”

কমলা। তোমারই নাকি জন্ম হইয়াছিল! তুমি নাকি বহুকালের লোক!–তার পরে?

রমেশ। সেই ক্ষত্রিয়দের নিয়ম ছিল, তাহার নিজে বিবাহ করিতে না গিয়া তলোয়ার পাঠাইয়া দিত। সেই তলোয়ারের সহিত বধূর বিবাহ হইয়া গেলে তাহাকে বাড়িতে আনিয়া আবার বিবাহ করিত।

কমলা। না না, ছিঃ! ও কী রকম বিবাহ!

রমেশ। আমিও ও রকম বিবাহ পছন্দ করি না,কিন্তু কী করিব, যে ক্ষত্রিয়দের কথা বলিতেছি তাহারা শ্বশুরবাড়ি নিজে গিয়া বিবাহ করিতে অপমান বোধ করিত। আমি যে রাজার গল্প বলিতেছি সে ঐ জাতের ক্ষত্রিয় ছিল। একদিন সে–

কমলা। তুমি তো বলিলে না, সে কোথাকার রাজা?

রমেশ বলিয়া দিল, “মদ্রদেশের রাজা। একদিন সেই রাজা–”

কমলা। রাজার নাম কী আগে বলো।

কমলা সকল কথা স্পষ্ট করিয়া লইতে চায়, তাহার কাছে কিছুই উহ্য রাখিলে চলিবে না। রমেশ এতটা জানিলে আগে হইতে আরো বেশি প্রস্তুত হইয়া থাকিত; এখন দেখিল, কমলার গল্প শুনিতে যতই আগ্রহ থাক্‌, গল্পের কোনো জায়গায় তাহার ফাঁকি সহ্য হয় না।

রমেশ হঠাৎ প্রশ্নে একটু থমকিয়া বলিল, “রাজার নাম রণজিৎ সিং।”

কমলা একবার আবৃত্তি করিয়া লইল, “রণজিৎ সিং, মদ্রদেশের রাজা। তার পরে?”

রমেশ। তার পরে একদিন রাজা ভাটের মুখে শুনিলেন, তাঁহারই জাতের আর-এক রাজার এক পরমাসুন্দরী কন্যা আছে।

কমলা। সে আবার কোথাকার রাজা?

রমেশ। মনে করো, সে কাঞ্চীর রাজা।

কমলা। মনে করিব কী! তবে সত্য কি সে কাঞ্চীর রাজা নয়?

রমেশ। কাঞ্চীরই রাজা বটে। তুমি তার নাম জানিতে চাও? তার নাম অমর সিং।

কমলা। সেই মেয়ের নাম তো বলিলে না?–সেই পরমাসুন্দরী কন্যা!

রমেশ। হাঁ হাঁ, ভুল হইয়াছে বটে। সেই মেয়ের নাম–তাহার নাম–ওঃ, তাহার নাম চন্দ্রা–

কমলা। আশ্চর্য! তুমি এমন ভুলিয়া যাও! তুমি তো আমারই নাম ভুলিয়াছিলে।

রমেশ। কোশলের রাজা ভাটের মুখে এই কথা শুনিয়া–

কমলা। কোশলের রাজা কোথা হইতে আসিল? তুমি যে বলিলে মদ্রদেশের রাজা–

রমেশ। সে কি এক জায়গার রাজা ছিল মনে কর? সে কোশলেরও রাজা, মদ্রেরও রাজা।

কমলা। দুই রাজ্য বুঝি পাশাপাশি?

রমেশ। একেবারে গায়ে গায়ে লাগাও।

এইরূপে বারংবার ভুল করিতে করিতে ও সতর্ক কমলার প্রশ্নের সাহায্যে সেইসকল ভুল কোনোমতে সংশোধন করিতে করিতে রমেশ এইরূপ ভাবে গল্পটি বলিয়া গেল–

মদ্ররাজ রণজিৎ সিং কাঞ্চীরাজের নিকট রাজকন্যাকে বিবাহ করিবার প্রস্তাব জানাইয়া দূত পাঠাইয়া দিলেন। কাঞ্চীর রাজা অমর সিং খুশি হইয়া সম্মত হইলেন।

তখন রণজিৎ সিংহের ছোটো ভাই ইন্দ্রজিৎ সিং সৈন্যসামন্ত লইয়া নিশান উড়াইয়া কাড়া-নাকাড়া দুন্দুভি-দামামা বাজাইয়া কাঞ্চীর রাজোদ্যানে গিয়া তাঁবু ফেলিলেন। কাঞ্চীনগরে উৎসবের সমারোহ পড়িয়া গেল।

0 Shares