নৌকা ডুবি

রাজার দৈবজ্ঞ গণনা করিয়া শুভ দিনক্ষণ স্থির করিয়া দিল। কৃষ্ঞা দ্বাদশীতিথিতে রাত্রি আড়াই প্রহরের পর লগ্ন। রাত্রে নগরের ঘরে ঘরে ফুলের মালা দুলিল এবং দীপাবলী জ্বলিয়া উঠিল। আজ রাত্রে রাজকুমারী চন্দ্রার বিবাহ।

কিন্তু কাহার সহিত বিবাহ রাজকন্যা চন্দ্রা সে কথা জানেন না। তাঁহার জন্মকালে পরমহংস পরমানন্দস্বামী রাজাকে বলিয়াছিলেন, “তোমার এই কন্যার প্রতি অশুভগ্রহের দৃষ্টি আছে, বিবাহকালে পাত্রের নাম যেন এ কন্যা জানিতে না পারে।’

যথাকালে তরবারির সহিত রাজকন্যার গ্রন্থিবন্ধন হইয়া গেল। ইন্দ্রজিৎ সিং যৌতুক আনিয়া তাঁহার ভ্রাতৃবধূকে প্রণাম করিলেন। মদ্ররাজ্যের রণজিৎ এবং ইন্দ্রজিৎ যেন দ্বিতীয় রামলক্ষ্মণ ছিলেন। ইন্দ্রজিৎ আর্যা চন্দ্রার অবগুণ্ঠিত লজ্জারুণ মুখের দিকে তাকাইলেন না; তিনি কেবল তাঁহার নূপুরবেষ্টিত সুকুমার চরণযুগলের অলক্তরেখাটুকুমাত্র দেখিয়াছিলেন।

যথারীতি বিবাহের পরদিনেই মুক্তামালার-ঝালর-দেওয়া পালঙ্কে বধূকে লইয়া ইন্দ্রজিৎ স্বদেশের দিকে যাত্রা করিলেন। অশুভগ্রহের কথা স্মরণ করিয়া শঙ্কিতহৃদয়ে কাঞ্চীরাজ কন্যার মস্তকের উপরে দক্ষিণ হস্ত রাখিয়া আশীর্বাদ করিলেন, মাতা কন্যার মুখচুম্বন করিয়া অশ্রুজল সংবরণ করিতে পারিলেন না–দেবমন্দিরে সহস্র গ্রহবিপ্র স্বস্ত্যয়নে নিযুক্ত হইল।

কাঞ্চী হইতে মদ্র বহুদূর, প্রায় এক মাসের পথ। দ্বিতীয় রাত্রে যখন বেতসা-নদীর তীরে শিবির রাখিয়া ইন্দ্রজিতের দলবল বিশ্রামের আয়োজন করিতেছে, এমন সময় বনের মধ্যে মশালের আলো দেখা গেল। ব্যাপারখানা কী জানিবার জন্য ইন্দ্রজিৎ সৈন্য পাঠাইয়া দিলেন।

সৈনিক আসিয়া কহিল, “কুমার, ইহারাও আর-একটি বিবাহের যাত্রিদল। ইহারাও আমাদের স্বশ্রেণীয় ক্ষত্রিয়, অস্ত্রোদ্‌বাহ সমাধা করিয়া বধূকে পতিগৃহে লইয়া চলিয়াছে। পথে নানা বিঘ্নভয় আছে, তাই ইহারা কুমারের শরণ প্রার্থনা করিতেছে; আদেশ পাইলে কিছুদূর পথ ইহারা আমাদের আশ্রয়ে যাত্রা করে।”

কুমার ইন্দ্রজিৎ কহিলেন, “শরণাপন্নকে আশ্রয় দেওয়া আমাদের ধর্ম। যত্ন করিয়া ইহাদিগকে রক্ষা করিবে।”

এইরূপে দুই শিবির একত্র মিলিত হইল।

তৃতীয় রাত্রি অমাবস্যা। সম্মুখে ছোটো ছোটো পাহাড়, পশ্চাতে অরণ্য। শ্রান্ত সৈনিকেরা ঝিল্লির শব্দে ও অদূরবর্তী ঝর্নার কলধ্বনিতে গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন।

এমন সময়ে হঠাৎ কলরবে সকলে জাগিয়া উঠিয়া দেখিল, মদ্র-শিবিরের ঘোড়াগুলি উন্মত্তের ন্যায় ছুটাছুটি করিতেছে–কে তাহাদের রজ্জু কাটিয়া দিয়াছে–এবং মাঝে মাঝে এক-একটা তাঁবুতে আগুন লাগিয়াছে ও তাহার দীপ্তিতে অমারাত্রি রক্তিমবর্ণ হইয়া উঠিয়াছে।

বুঝা গেল, দস্যু আক্রমণ করিয়াছে। মারামারি-কাটাকাটি বাধিয়া গেল–অন্ধকারে শত্রু-মিত্র ভেদ করা কঠিন; সমস্ত উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠিল। দস্যুরা সেই সুযোগে লুটপাট করিয়া অরণ্যে-পর্বতে অন্তর্ধান করিল।

যুদ্ধ-অন্তে রাজকুমারীকে আর দেখা গেল না। তিনি ভয়ে শিবির হইতে বাহির হইয়া পড়িয়াছিলেন এবং একদল পলায়নপর লোককে স্বপক্ষ মনে করিয়া তাহাদের সহিত মিশিয়া গিয়াছিলেন।

তাহারা অন্য বিবাহের দল। গোলেমালে তাহাদের বধূকে দস্যুরা হরণ করিয়া লইয়া গেছে। রাজকন্যা চন্দ্রাকেই তাহারা নিজেদের বধূ জ্ঞান করিয়া দ্রুতবেগে স্বদেশে যাত্রা করিল।

তাহারা দরিদ্র ক্ষত্রিয়; কলিঙ্গে সমুদ্রতীরে তাহাদের বাস। সেখানে রাজকন্যার সহিত অন্যপক্ষের বরের মিলন হইল। বরের নাম চেৎসিং।

চেৎসিংহের মা আসিয়া বরণ করিয়া বধূকে ঘরে তুলিয়া লইলেন। আত্মীয়স্বজন সকলে আসিয়া কহিল, “আহা, এমন রূপ তো দেখা যায় না।”

মুগ্ধ চেৎসিং নববধূকে ঘরের কল্যাণলক্ষ্মী বলিয়া মনে মনে পূজা করিতে লাগিল। রাজকন্যাও সতীধর্মের মর্যাদা বুঝিতেন; তিনি চেৎসিংকে আপন পতি বলিয়া জানিয়া তাহার নিকট মনে মনে আত্মজীবন উৎসর্গ করিয়া দিলেন।

নবপরিণয়ের লজ্জা ভাঙিতে কিছুদিন গেল। যখন লজ্জা ভাঙিল তখন কথায় কথায় চেৎসিং জানিতে পারিল যে, যাহাকে সে বধূ বলিয়া ঘরে লইয়াছে, সে রাজকন্যা চন্দ্রা।

২৬

কমলা রুদ্ধনিশ্বাসে একান্ত আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিল, “তার পরে?”

রমেশ কহিল, “এই পর্যন্তই জানি, তার পরে আর জানি না। তুমিই বলো দেখি, তার পরে কী।”

কমলা। না না, সে হইবে না, তার পরে কী আমাকে বলো।

রমেশ। সত্য বলিতেছি, যে গ্রন্থ হইতে এই গল্প পাইয়াছি তাহা এখনো সম্পূর্ণ প্রকাশিত হয় নাই–শেষের অধ্যায়গুলি কবে বাহির হইবে কে জানে।

কমলা অত্যন্ত রাগ করিয়া কহিল, “যাও, তুমি ভারি দুষ্ট! তোমার ভারি অন্যায়।”

রমেশ। যিনি বই লিখিতেছেন তাঁর সঙ্গে রাগারাগি করো। তোমাকে আমি কেবল এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতেছি, চন্দ্রাকে লইয়া চেৎসিং কী করিবে?

কমলা তখন নদীর দিকে চাহিয়া ভাবিতে লাগিল; অনেকক্ষণ পরে কহিল, “আমি জানি না, সে কী করিবে–আমি তো ভাবিয়া উঠিতে পারি না।”

রমেশ কিছুক্ষণ স্তব্ধ হইয়া রহিল; কহিল, “চেৎসিং কি সকল কথা চন্দ্রাকে প্রকাশ করিয়া বলিবে?”

কমলা কহিল, “তুমি বেশ যা হোক, না বলিয়া বুঝি সমস্ত গোলমাল করিয়া রাখিবে? সে যে বড়ো বিশ্রী। সমস্ত স্পষ্ট হওয়া চাই তো।”

0 Shares