নৌকা ডুবি

কমলা কোনোমতেই ভাবিয়া পাইল না, তাহার মনের মধ্যে কী একটা গূঢ় বেদনা পীড়ন করিতেছে। শরৎকালের এই শিশিরবাষ্পাম্বরা উষা কেন আজ তাহার আনন্দমূর্তি উদ্‌ঘাটন করিতেছে না? কেন একটা অশ্রুজলের আবেগ বালিকার বুকের ভিতর হইতে কণ্ঠ বাহিয়া চোখের কাছে বার বার আকুল হইয়া উঠিতেছে? তাহার শ্বশুর নাই, শাশুড়ি নাই, সঙ্গিনী নাই, স্বজন-পরিজন কেহই নাই, এ কথা কাল তো তাহার মনে ছিল না– ইতিমধ্যে কী ঘটিয়াছে যাহাতে আজ তাহার মনে হইতেছে, একলা রমেশমাত্র তাহার সম্পূর্ণ নির্ভরস্থল নহে? কেন মনে হইতেছে, এই বিশ্বভুবন অত্যন্ত বৃহৎ এবং সে বালিকা, অত্যন্ত ক্ষুদ্র?

কমলা অনেকক্ষণ দরজা ধরিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। নদীর জলপ্রবাহ তরল স্বর্ণস্রোতের মতো জ্বলিতে লাগিল। খালাসিরা তখন কাজে লাগিয়াছে, এঞ্জিন ধক্‌ ধক্‌ করিতে আরম্ভ করিয়াছে, নোঙর-তোলা ও জাহাজ-ঠেলাঠেলির শব্দে অকালজাগ্রত শিশুর দল নদীর তীরে ছুটিয়া আসিয়াছে।

এমন সময় রমেশ এই গোলমালে জাগিয়া উঠিয়া কমলার খবর লইবার জন্য তাহার দ্বারের সম্মুখে আসিয়া উপস্থিত হইল। কমলা চকিত হইয়া, আঁচল যথাস্থানে থাকা সত্ত্বেও তাহা আর-একটু টানিয়া আপনাকে যেন বিশেষভাবে আচ্ছাদনের চেষ্টা করিল।

রমেশ কহিল, “কমলা, তোমার মুখ-হাত ধোওয়া হইয়াছে?”

এই প্রশ্নে কেন যে কমলার রাগ হইতে পারে, তাহা তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলে সে কিছুতেই বলিতে পারিত না। কিন্তু হঠাৎ রাগ হইল। সে অন্য দিকে মুখ করিয়া কেবল মাথা নাড়িল মাত্র।

রমেশ কহিল, “বেলা হইলে লোকজন উঠিয়া পড়িবে, এইবেলা তৈরি হইয়া লও না।”

কমলা তাহার কোনো উত্তর না করিয়া কোঁচানো শাড়ি গামছা ও একটি জামা চৌকির উপর হইতে তুলিয়া লইয়া দ্রুতপদে রমেশের পাশ দিয়া স্নানের ঘরে চলিয়া গেল।

রমেশ যে প্রাতঃকালে উঠিয়া কমলাকে এই যত্নটুকু করিতে আসিল ইহা কমলার কাছে কেবল যে অত্যন্ত অনাবশ্যক বোধ হইল তাহা নহে, ইহা যেন তাহাকে অপমান করিল। রমেশের আত্মীয়তার সীমা যে কেবল খানিকটা দূর পর্যন্ত, এক জায়গায় আসিয়া তাহা যে বাধিয়া যায়, ইহা সহসা কমলা অনুভব করিতে পারিয়াছে। শ্বশুরবাড়ির কোনো গুরুজন তাহাকে লজ্জা করিতে শেখায় নাই, মাথায় কোন্‌ অবস্থায় ঘোমটার পরিমাণ কতখানি হওয়া উচিত তাহাও তাহার অভ্যস্ত হয় নাই– কিন্তু রমেশ সম্মুখে আসিতেই আজ কেন অকারণে তাহার বুকের ভিতরটা লজ্জায় কুণ্ঠিত হইতে লাগিল।

স্নান সারিয়া কমলা যখন তাহার কামরায় আসিয়া বসিল তখন তাহার দিনের কর্ম তাহার সম্মুখবর্তী হইল। কাঁধের উপর হইতে আঁচলে-বাঁধা চাবির গোছা লইয়া কাপড়ের পোর্ট্‌ম্যাণ্টো খুলিতেই তাহার মধ্যে ছোটো ক্যাশবাক্সটি নজরে পড়িল। এই ক্যাশবাক্সটি পাইয়া কাল কমলা একটি নূতন গৌরব লাভ করিয়াছিল। তাহার হাতে একটি স্বাধীন শক্তি আসিয়াছিল। তাই সে বহু যত্ন করিয়া বাক্সটি তাহার কাপড়ের তোরঙ্গের মধ্যে চাবি-বন্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। আজ কমলা সে বাক্স হাতে তুলিয়া লইয়া উল্লাসবোধ করিল না। আজ এ বাক্সকে ঠিক নিজের বাক্স মনে হইল না, ইহা রমেশেরই বাক্স। এ বাক্সের মধ্যে কমলার পূর্ণস্বাধীনতা নাই। সুতরাং এ টাকার বাক্স কমলার পক্ষে একটা ভারমাত্র।

রমেশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া কহিল, “খোলা বাক্সের মধ্যে কী হেঁয়ালির সন্ধান পাইয়াছ? চুপচাপ বসিয়া যে?”

কমলা ক্যাশবাক্স তুলিয়া ধরিয়া কহিল, “এই তোমার বাক্স।”

রমেশ কহিল, “ও আমি লইয়া কী করিব?”

কমলা কহিল, “তোমার যেমন দরকার সেই বুঝিয়া আমাকে জিনিসপত্র আনাইয়া দাও।”

রমেশ। তোমার বুঝি কিছুই দরকার নাই?

কমলা ঘাড় ঈষৎ বাঁকাইয়া কহিল, “টাকায় আমার কিসের দরকার?”

রমেশ হাসিয়া কহিল, “এতবড়ো কথাটা কয়জন লোক বলিতে পারে! যা হোক্‌ যেটা তোমার এত অনাদরের জিনিস সেইটেই কি পরকে দিতে হয়? আমি ও লইব কেন?”

কমলা কোনো উত্তর না করিয়া মেজের উপর ক্যাশবাক্স রাখিয়া দিল।

রমেশ কহিল, “আচ্ছা কমলা, সত্য করিয়া বলো, আমি আমার গল্প শেষ করি নাই বলিয়া তুমি আমার উপর রাগ করিয়াছ?”

কমলা মুখ নিচু করিয়া কহিল, “রাগ কে করিয়াছে?”

রমেশ। রাগ যে না করিয়াছে সে ঐ ক্যাশবাক্সটি রাখুক; তাহা হইলেই বুঝিব, তাহার কথা সত্য।

কমলা। রাগ না করিলেই বুঝি ক্যাশবাক্স রাখিতে হইবে? তোমার জিনিস তুমি রাখো-না কেন?

রমেশ। আমার জিনিস তো নয়; দিয়া কাড়িয়া লইলে যে মরিয়া ব্রহ্মদৈত্য হইতে হইবে। আমার বুঝি সে ভয় নাই?

রমেশের ব্রহ্মদৈত্য হইবার আশঙ্কায় কমলার হঠাৎ হাসি পাইয়া গেল। সে হাসিতে হাসিতে কহিল, “কক্‌খনো না। দিয়া কাড়িয়া লইলে বুঝি ব্রহ্মদৈত্য হইতে হয়? আমি তো কখনো শুনি নাই।”

এই অকস্মাৎ হাসি হইতে সন্ধির সূত্রপাত হইল। রমেশ কহিল, “অন্যের কাছে কেমন করিয়া শুনিবে? যদি কখনো কোনো ব্রহ্মদৈত্যের দেখা পাও, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেই সত্যমিথ্যা জানিতে পারিবে।”

কমলা হঠাৎ কুতূহলী হইয়া উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আচ্ছা, ঠাট্টা নয়, তুমি কখনো সত্যকার ব্রহ্মদৈত্য দেখিয়াছ?”

রমেশ কহিল, “সত্যকার নয় এমন অনেক ব্রহ্মদৈত্য দেখিয়াছি। ঠিক খাঁটি জিনিসটি সংসারে দুর্লভ।”

কমলা। কেন, উমেশ যে বলে–

রমেশ। উমেশ? উমেশ ব্যক্তিটি কে?

0 Shares